দৈনিক ফেনীর সময়

টুঙ্গিপাড়া ভ্রমণ

টুঙ্গিপাড়া ভ্রমণ

প্রফেসর কামরুন নাহার

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ অবস্থিত। সেই সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, দোয়া ও পৈতৃক নিবাস দেখাই ভ্রমণের উদ্দেশ্য।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর থেকেই শিক্ষকদের মনে খুব আনন্দ উচ্ছ্বাস জমে ওঠে এবার গোপালগঞ্জ টুঙ্গিপাড়া যেতে রাস্তা সহজ হয়েছে। প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল গোপালগঞ্জ টুঙ্গিপাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন ও দোয়া পাঠ করার। সিদ্ধান্ত হলো আমরা একদিনের সফরে যাব সকালে যেয়ে রাতে ফিরে আসব। শিক্ষকরা দায়িত্ব নিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করা করলো।

শোকাবহ আগস্ট মাস ,এ মাসের ১৫ তারিখ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছেন, তাই ১৫ ই আগস্ট আমাদের জাতীয় শোক দিবস। শোকাবহ আগস্ট বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত হল সবাই কালো ড্রেস পড়বে। যেই কথা সেই কাজ। শুরু হলো কালো পাঞ্জাবি ও শাড়ির সংগ্রহের কাজ। সবাই একসাথে একই ড্রেস পরে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখা।

ঠিক হলো এক দিনের যাত্রা সকাল ৫: ৪০ এ বাস ছেড়ে যাবে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে। ৫:৪০ এর মধ্যেই সবাই স্টার লাইন বাসে চড়ে যাত্রা শুরু করলো, ৯টার মধ্যে ঢাকা পৌঁছে বাস পরিবর্তন করে টুরিস্ট বাসে টুঙ্গিপাড়া রওয়ানা হলাম।

মাওয়া হাই রোড কি সুন্দর, সাজানো পরিপাটি, কোথাও কোন ময়লা নেই, কোন ক্রসিং নেই , মসৃণ শ্যামল সবুজ প্রকৃতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি চলে আসলাম স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উপর। ব্রিজে ওঠার সময় সবাই বলল, বাস আস্তে আস্তে যাবে যেহেতু ব্রিজের উপর নামার অনুমতি নেই। সবাই যেন বাসে বসেই ব্রিজের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে এবং ছবি উঠানো, ভিডিও করা, লাইভ করা ইত্যাদি কাজগুলোও আনন্দের সাথে করতে পারে। ব্রিজের উপর সবাই খুব আনন্দ করল, কেউ সামনে বসে, কেউ জানালা খুলে, কেউ দরজা খুলে ছবি উঠাতে লাগলো, কেউ ভিডিও করতে আবার কেউ লাইভে এসে ভ্রমণের বর্ণনা শুরু করে দিল, স্বপ্নের পদ্মা সেতু স্বপ্নের মত মনে হল যতক্ষণ ব্রিজের উপরে ছিলাম।

তারপর আবার যাত্রা শুরু হল কখন গন্তব্যে পৌঁছাবে সেই অপেক্ষায়। রাস্তার দু’পাশের মনোরম দৃশ্য, সুদূর প্রসারের রাস্তা দেখতে দেখতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম টুঙ্গিপাড়া যেখানে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাহিত আছেন। বেলা তখন ১২.৩০। পৌঁছে আমরা প্রথমেই চলে গেলাম আমাদের লক্ষ্য স্থলে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে। বাস থেকে সবাই সারিবদ্ধভাবে নেমে আমাদের ব্যানার ও ফুলের তোড়া নিয়ে রেলি করে সমাধি পর্যন্ত হেঁটে পৌঁছালাম। তারপর সবাই বঙ্গবন্ধুর সমাধির ব্যাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সুরা ফাতেহা ও ইখলাস পাঠ করে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের জন্য দোয়া পাঠ করার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রধান ও প্রথম উদ্দেশ্য সফল হল।

সমাধি কমপ্লেক্সের ভিতরে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধুর কবর, লাল সিরামিক ইট ও সাদা কালো টালইস দ্বারা নির্মিত সৌধের কারু কাজ ফুটে উঠেছে বেদনার চিহ্ন। বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশেই তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা শেখ সায়েরা খাতুনের কবর। কবর তিনটি নিরাপত্তার জন্য ঘিরে রাখা হয়েছে রেলিং দিয়ে। আর তিনটি কবরকে ঘিরে মূল স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। উপরে সাদা পাথরের তৈরি গোলাকার একটি গম্বুজ রযেছে। সমাধি সৌধের উপরের দেয়ালগুলো জাফরি কাটা যার ভিতর দিয়ে আলো প্রবেশ করতে পারে। গম্বুজের সামনে বাগান বিলাস গাছ ও ফুলে সমাহিত এক মন মুগ্ধকর সমাধি সৌধ।

বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধের পাশে পৈতৃক পুরানো বাড়ি ইট দিয়ে সাজানো অসম্পূর্ণ অবস্থায় আছে। এ বাড়ির একটি ঘরে ১৯২০ সালে ১৭ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা শেখ সায়েরা খাতুন আদর করে ডাকতেন খোকা বলে। মহানায়কের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, শৈশব কৈশোর কেটেছে এ বাড়িতেই।
বাড়ির পাশেই মসজিদ যেখানে দর্শনার্থী সবাই নামাজ আদায় করতে পারে। সমাধির পাশে রয়েছে একটি জাদুঘর ও পাঠাগার। জাদুঘরের ভিতরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জড়িত ছবিগুলো বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী, রাজনৈতিক জীবন, স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদান, দেশ-বিদেশের সাথে ভাতৃত্বপূর্ণ মনোভাব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।

বঙ্গবন্ধুকে যে কফিনে করে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল সে কফিনটিও সংরক্ষণ করা হয়েছে কাচের বাক্সের মধ্যে সেই জাদুঘরে। একটি পাঠাগার রয়েছে প্রচুর বই সারি সারি তাকে সাজানো। বই দেখে সবাই মুগ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত বই। সুশৃংখলভাবে সবাই দেখছে, পড়ছে, ছবি উঠাচ্ছে ও বঙ্গবন্ধুকে নতুন করে জানতে পারছে।

চারিপাশে অনেক মনোরম পরিবেশ, দর্শনার্থীদের বসার জায়গা, ফুলের বাগান, খোলা উদ্যান, একটি পুকুরসহ দর্শনীয় অনেক কিছু রয়েছে। পুকুরের চারিদিকে গাছ গাছালি বসার বেঞ্চিসহ ঘাটলা রয়েছে। পুকুরের ঠান্ডা হাওয়া ক্লান্তি দূর করে মনকে সতেজ করে তোলে। সেই পুকুরে ও পুকুর পড়ে বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা অনেক সময় কাটিয়েছে।

দেখতে দেখতে দু’ঘণ্টা চলে গিয়েছে, দুপুরের খাবার উদ্দেশ্যে আমরা পর্যটন হোটেলে পৌঁছালাম। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ রুচিসম্মত ভাত, মাছ, মুরগি সবজি ও ডাল দিয়ে দুপুরের খাওয়া সম্পন্ন হল। কিছুক্ষন বাহিরে ঘুরাঘুরি, খোলা ভ্যানে চড়া ও চা খাওয়া হল।
বিকালে বৃষ্টির মধ্যে মধুমতি ব্রীজ ও নদী দেখে ফেরার যাত্রা শুরু হল। আল্লাহর অশেষ রহমতে সুন্দরভাবে ভ্রমণ শেষ করে গ্রামীণ রাস্তা ধরে আবার বাস চলতে শুরু করল ফেনীর উদ্দেশ্যে। খুব সুন্দর চারিদিকে গাছ, নদী, খাল বিল, ফসলাদি ও প্রকৃতির ঠান্ডা হওয়ার মধ্য দিয়ে নিরাপদে পৌঁছে গেলাম জাজিয়া প্রান্তে। আবার স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উপড়ে ওঠে আস্তে আস্তে বাস চল্লো ,তখন পশ্চিম আকাশে লাল সূর্যাস্ত দেখা যাচ্ছে। সে এক অন্যরকম অনুভুতি সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখে সবাই মুগ্ধ ও আনন্দিত।

মাওয়া এসে বাস চলে গেল মাওয়া ঘাটে যেখানে টাটকা ইলিশ দিয়ে নৈশ ভোজ হবে। টাটকা ইলিশ বাছাই করে রান্না ও খাবারের অর্ডার দেওয়া হলো ১৬ আনা দেশি খাবার হোটেলে। যেখানে প্লেট, গøাস ও বাটি সবই মাটির তৈরি, ভালোই লেগেছে ছোট বেলায় গ্রামের বাড়িতে ব্যবহার করেছি। পদ্মার পাড়ে বসে পদ্মার ইলিশ খেয়ে সবাই টুঙ্গিপাড়া ভ্রমণের শেষ তৃপ্তিটা অনুভব করলো সবাই তারপর বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করলো। বাসে চড়ে সবাই টুঙ্গিপাড়া ভ্রমনের আনন্দ অনুভূতি ব্যক্ত করলো। রাত ১০ টার মধ্যে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে মধ্য রাত ১টার সময় নিজ ক্যাম্পাসে পৌঁছার মধ্য দিয়ে ভ্রমনের সমাপ্তি হলো।
লেখক : অধ্যক্ষ, সরকারি জিয়া মহিলা কলেজ, ফেনী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!