দৈনিক ফেনীর সময়

ফেনী জেলা শিক্ষক সমিতি : লুটেপুটে খেলো মোসাদ্দেক

ফেনী জেলা শিক্ষক সমিতি : লুটেপুটে খেলো মোসাদ্দেক

আরিফ আজম :

২০১৫ সালে ফেনী জেলা শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সভাপতি ডিএম একরামুল হক ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মীর হোসেন ভূঁইয়া। সেবছর তাদের জোরপূর্বক সরিয়ে দিয়ে নতুন কমিটি করা হয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সমিতির সভাপতি হন ছাগলনাইয়ার বাঁশপাড়া আইডিয়াল একাডেমীর প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান পাটোয়ারী ও সাধারণ সম্পাদক হন লস্করহাট এসসি লাহা ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক মোসাদ্দেক আলী। তিন মেয়াদে দায়িত্বপালন কালে কাগজকলমে সভাপতি থাকলেও মোসাদ্দেক আলীর ইশারায় চলতো সমিতির কার্যক্রম। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর নিকটাত্মীয় এবং জেলা আওয়ামীলীগের শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক পদে থাকায় তার ভয়ে শিক্ষকদের কেউ কথা বলার সাহস পেতো না। যার ফলে শিক্ষক ভবন কুক্ষিগত করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন মোসাদ্দেক। একসময় জেলার মাধ্যমিক শিক্ষকদের পদচারণায় শহরের বাঁশপাড়ার শিক্ষক ভবন সরগরম থাকলেও দীর্ঘদিন অনেকটা নির্জীব। সমিতির অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষকদের প্রকাশ্য দলাদলি সহ সবকিছুর নাটের গুরু ছিলেন মোসাদ্দেক আলী।

জানা গেছে, প্রথম দুই মেয়াদে মোসাদ্দেক আলীর সঙ্গে সভাপতি ছিলেন হাবিবুর রহমান ও তৃতীয় মেয়াদে ছিলেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পাঁচগাছিয়া এজেড খান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রধান শিক্ষক ফয়েজ আহমদ ফকির। সমিতির সদস্য সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজার হলেও অবসরে চলে গেছেন ৬শ শিক্ষক-শিক্ষিকা। অবসরের পর সমিতির ফান্ডে সঞ্চিত টাকার তিনগুন পাওয়ার কথা থাকলেও কোন শিক্ষকই টাকা পাননি। এদের মধ্যে কেউ কেউ পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। এনিয়ে শিক্ষক পরিবারে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট থেকে দলীয় নেতাদের সাথে আত্মগোপনে চলে যান মোসাদ্দেক। ৮ বছরের বেশি সময় ধরে সমিতি ভবনের ব্যাংক ও দোকান ভাড়া, শিক্ষকদের সঞ্চিত টাকা ইচ্ছেমত আত্মসাত করেছেন। তার এসব অপকর্মের সহযোগি ছিলেন সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও মোটবী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সদ্য পদত্যাগ করা প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম। তিনি মোটবী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি। যার ফলে ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ফয়েজ আহম্মদ ফকিরকে সভাপতি ও প্রতাপপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম কিবরিয়াকে সদস্য সচিব করে এডহক কমিটি কেন্দ্র থেকে অনুমোদন দেয়া হয়। ফয়েজ-কিবরিয়া কমিটির মেয়াদ তিনবার বাড়ানো হলেও মোসাদ্দেক আলীর দাপটের মুখে তারা কার্যক্রমই শুরু করতে পারেনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষক সমিতির নিজস্ব একাউন্ট জনতা ব্যাংকে থাকলেও মামলার প্রেক্ষিতে সেটির লেনদেন স্থগিত করা হয়। এ সুবাধে সমিতির সঞ্চয়ের টাকা সাউথইস্ট ব্যাংকে মোসাদ্দেক আলী নিজের একাউন্টে জমা রাখেন। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই ওই একাউন্টে এক চেকেই উত্তোলন করেন ৭ লাখ টাকা। একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর তোলা হয় সাড়ে ৪ লাখ টাকা। ২২ নভেম্বর তোলা হয় ৮ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১৯ সালের ১০ জুন ৫০ হাজার, ২ জুলাই ৮ লাখ, ১১ সেপ্টেম্বর ৭৫ হাজার, ৩০ ডিসেম্বর ১ লাখ, ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি ৬ লাখ, ২৫ জুলাই ২ লাখ ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন মোসাদ্দেক। এভাবে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাত করে নামে-বেনামে বিল-ভাউচার করেছেন। অথচ ২০২০ সালে জেলা শিক্ষক সমিতি সম্মেলনের কথা বলে সমিতির ফান্ড থেকে ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৫৯০ টাকার ভাউচার করেন। এর মধ্যে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বাবদ ৭০ হাজার, সাউন্ড সিস্টেম ৪ হাজার, অতিথিদের খাওয়া বাবদ ৫৫ হাজার, ভিডিও বাবদ ৪ হাজার, সম্মানি/ পারিশ্রমিক বাবদ ১ হাজার, আইনশৃঙ্খলা নিরাপত্তায় ১ লাখ ৩০ হাজার, ব্যানার ৫ হাজার, চা-নাস্তা বাবদ ১২ হাজার ৫শ, অতিথিদের সম্মানি ৫০ হাজার, মাইক ভাড়া ১০ হাজার, স্বেচ্ছাসেবক সম্মানি ২৩ হাজার ৬শ, যাতায়াত ৪২ হাজার ৫৪০, কাউন্সিলরদের সম্মানি ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮শ ৫০, বিবাদ মেটানো বাবদ ৩০ হাজার, চেয়ার-টেবিল ভাড়া ১৯ হাজার ৫শ, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ৪ হাজার, সভাপতি হাবিবুর রহমান পাটোয়ারীর যাতায়াত ৫ হাজার, শিক্ষকদের নিয়ে এমপির সাথে দেখা বাবদ ২০ হাজার টাকা খরচ দেখান মোসাদ্দেক আলী। সেদিন অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান না হলেও ১০ হাজার টাকার ভাউচার করা হয়।

ডিএম একরামুল হকের ছেলে আবু নাইম মো: ইরফানুল হক ফেনীর সময় কে জানান, “তার বাবা বেগম সামছুন্নাহার গালর্স স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক পদ থেকে ২০১৩ সালে চাকুরী থেকে অবসরে গেছেন। ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তিনি মারা গেলেও অদ্যাবধি সঞ্চিত টাকা পাননি।”

২০২৪ সালে গঠিত এডহক কমিটি বিগত সময়ের হিসাব-নিকাশের জন্য অডিট কমিটি গঠন করলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। অডিট কমিটির আহবায়ক ও সুন্দরপুর এসআর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমির হোসেন জানান, অডিট কার্যক্রম চলাকালে সমিতির অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। ফলে সেটি আর বেশিদূর এগোয়নি। ওই কমিটির সদস্য ছিলেন রামপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল হাশেম, কালিদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন, শর্শদী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি দেবনাথ ও দাগনভূঞার জায়লস্কর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ইসমাইল হোসেন সিরাজী।

এ ব্যাপারে সোমবার রাতে বক্তব্য জানতে মোসাদ্দেক আলীর মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!