দৈনিক ফেনীর সময়

তালেব আলী: সততার আলোকবর্তিকা

তালেব আলী: সততার আলোকবর্তিকা

-মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন

ছোট ফেনী নদী তীরবর্তি অজোপাড়া গাঁয়ে বেড়ে উঠা। আলোকবর্তিকা হাতে ছুটে চলেছেন সোনাগাজীর চরগোপালগাঁও থেকে বিষ্ণুপুর। সেখান থেকে ফেনী। মানুষের অধিকার আদায়ে ক্রমেই বজ্রকণ্ঠ হয়ে উঠেন জাতীয় সংসদেও। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা আর রাজনীতি এককথায় সমাজসেবায় সব বাঁকেই তিনি আলো জ্বালিয়েছেন। বলছিলাম সদ্য প্রয়াত এবিএম তালেব আলীর কথা। ছোট বেলা থেকেই এ নামের সঙ্গে পরিচয়। তবে আলোকিত এ মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হতে সময় লেগেছে। আমার নানা বাড়ীর সম্মুখেই তাঁর পৈত্রিক বাড়ী। মামা সফিউল্লাহ ভূঞার সঙ্গে তালেব আলীর সম্পর্ক কেবল বন্ধুত্বের নয়, অনেকটা পারিবারিক বন্ধনের। তালেব মামার মুখেই আমি শুনেছি আমার নানা-নানুর সান্নিধ্যে তাঁর শৈশব-কৈশোরে বেড়ে উঠার গল্প। আমার মা-খালারাও তাঁকে বড় ভাইয়ের মতোই জানতেন। তবে এক ব্যতিক্রমী চরিত্রের নাম তালেব আলী। তিনবারের সংসদ সদস্য হয়ে বর্ণাঢ্য রাজনীতিক জীবন গড়লেও জন্ম এলাকার মানুষের কাছে তিনি এখনো তালেব মাষ্টার হিসেবেই পরিচিত। নির্লোভ, নিরহংকার এ মানুষটি পৈত্রিক বাড়ি না দেখলে বোঝার উপায় নেই বর্তমান আর সাবেক রাজনীতিকদের জীবন চরিত্র। শহরের শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কে ছোট্ট বাড়িতে নিরবে-নিভৃতে কেটেছে জীবনের শেষ সময়কাল। কে খবর রেখেছে, আর কে রাখেননি এনিয়ে তাঁর কোন অভাব-অভিযোগ ছিলো না। তবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা-ভালোবাসার এতটুকু কম ছিলো না। এ বাড়িটিতে তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে অনেক সময় ধরে। তুলে ধরেছেন রাজনীতি, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা তথা সেকাল-একালের সমাজচিত্র। তখনকার সময়ে একজন রাজনৈতিক কর্মী আর এখনকার সময়ের প্রার্থক্য নিয়ে তিনি চরম হতাশা প্রকাশ করেন। সকল ক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয়ে দেশ ও জাতীর ভবিষ্যত নিয়ে তিনি শংকা প্রকাশ করেন। শেষসময়ে নিজের জীবনীগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েও শেষ করতে না পারার কথাও বলেন অকপটে। নানা সীমাবদ্ধতার কারনে সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারেননি। তিনি মনে করতেন- কোন ক্রমেই ভুল তথ্য জীবনীগ্রন্থে দেয়া যাবেনা। এতে তাঁর আজীবনের লালিত সততা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

১৯৩২ সালে সোনাগাজী উপজেলার চরমজলিশপুর ইউনিয়নের চরগোপালগাঁও গ্রামে তাঁর জন্ম। তার বাবা মৌলভী সাদাত আলী ও মা ফাতেমা বেগম। ৪ ভাই ও ১ বোনের মাঝে তিনি ছিলেন সবার ছোট। ছাত্রজীবনে চরলক্ষীগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়ার হাতেখড়ি তাঁর। ৩য় শ্রেণি পাশ করে বিষ্ণুপুর এম.ই. (মধ্যম ইংরেজি) স্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে পড়েন ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। ধলিয়া হাই স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে এখান থেকেই ১৯৫৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (এস.এস.সি) উত্তীর্ণ হন। সে বছর ফেনী দক্ষিণের একমাত্র ডিস্টিংশনে প্রথম শ্রেণি লাভ করে ফেনী কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ৫৬ সালে এইচ.এস.সি পাশ করে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে ভর্তি হলাম। বি.কম পাশ করি ৫৮ সালে। এ কলেজে থাকাকালেই ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িয়ে যান। সে সময় ‘স্টুডেন্টস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.কম ভর্তি হয়েও লেখাপড়া আর চালিয়ে যাননি।

¯’ানীয় জনগণের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে বিষ্ণুপুর হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবিএম তালেব আলী। ফেনী বালিকা বিদ্যানিকেতন সহ মাদরাসা, রাস্তা, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। বিষ্ণুপুরে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে ৭ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণির পাঠদান শুরু করেন। ১৯৬০ সালে এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার অনুমতিও মিলে। আমৃত্যু তিনি ওই স্কুলের সভাপতি ছিলেন।

শিক্ষক ইস্ট পাকিস্তান জুট ট্রেডিং কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান কোব্বাদ আহমদের অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে পদার্পন করেন জাতীয় ও ফেনীর রাজনীতির নানা বাঁকের স্বাক্ষী তালেব আলী। ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে ফেরদৌস আরা বেগমের সাথে বিয়ে হয় তার। কয়েক বছর আগে তিনিও ইন্তেকাল করেন। ২ ছেলে, ৩ মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে শিপের চিফ অফিসার; ছোট ছেলে ব্যাংকার, এনসিসি ব্যাংকে আছে।

কোব্বাদ আহমদের উদ্যোগে একই বছরের নভেম্বর মাসের শেষে আওয়ামীলীগের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী তাজউদ্দিন আহমদ, আবদুল মালেক উকিল, নুরুল হক, খাজা আহমদ বিষ্ণুপুর স্কুলের মাঠে এক জনসভার আয়োজন করেন। তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর অফিসে বসে আওয়ামীলীগে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান এবং ঢাকা গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের অনুরোধও জানিয়েছেন। পরে ’৬৮ সালের অক্টোবর মাসে পুরানা পল্টন¯’ আওয়ামীলীগ অফিসে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাত করেন। সদস্য ফি বাবদ ২ টাকা জমা দিয়ে সেদিন আওয়ামীলীগে যোগদান করেন।

১৯৭০ সালে আওয়ামীলীগের দলীয় প্রার্থী হিসাবে শিক্ষকতা ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নেন তালেব আলী। সে নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসাবে জয়ও পান। আওয়ামীলীগ-ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশের স্বপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের মানুষের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলন শুরু করে। সে আন্দোলনে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে।

নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরও বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না-করায় অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন তালেব আলী। এ অসহযোগ আন্দোলনই পরে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপ নেয়। এ আন্দোলনে আরো ছিলেন খাজা আহমদ, শামসুল হুদা (টুকটুক হুদা), ডা. ইসহাক চৌধুরী, আমিনুল করিম মজুমদার, আবদুর রহমান বি.কম সহ আরো কয়েকজন।

অসহযোগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে পৌঁছেছে, তখন কতিপয় শীর্ষ কর্মী নিয়ে খাজা আহমদ ও তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের চৌথাখোলায় চলে যান। সেখানে ক্যাম্প করে উপস্থিত কর্মীদের যুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং দিতে শুরু করেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভূমিকা ছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। খবর পান- ওই ক্যান্টনমেন্ট থেকে একটি ফোর্স আক্রমন করতে ফেনীতে রওনা হয়েছে। তাদেরকে প্রতিরোধ করতে একটি টিমকে প্রেরণ করা হয়। যুদ্ধের সময় তাঁর পরিবারের লোকজন উদয়পুর এলাকায় ছিল।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে ফেনী মহকুমা আওয়ামীলীগ কমিটির সেক্রেটারি করে পাঠান। সে কমিটির সভাপতি ছিলেন খাজা আহমদ। যুদ্ধকালীন সময়ে দার্জিলিংয়ে এক মিটিংয়ে এম.এন.এ (মেম্বার অব ন্যাশনাল এসেম্বলি) এবং এম.পি.এ (মেম্বার অব প্রভিন্সিয়াল এসেম্বলি) কে রূপান্তর করা হল- এম.সি.এ অর্থাৎ- মেম্বার অব কনস্ট্রিটুয়েন্ট এসেম্বলি। এই এম.সি.এ-রাই ’৭২-এর সংবিধান রচনা করে। ’৭৩ সালে জিলা কাউন্সিলে নির্বাচন হয়। তাতে তিনি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হন। তখন তিনি যুগবার্তা নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তালেব আলী কারাবরণ করেন। তাঁর জেলে থাকা অবস্থায় খাজা আহমদও মারা যান।

স্বাধীনতার পর ’৭৩ ও ’৭৯ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ফেনী জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ছাড়াও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রিয় কমিটির শ্রম সম্পাদক ছিলেন বহুকাল। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার করেন। এ পদে ছিলেন দীর্ঘ ২৬ বছর, ২০১৫ সাল পর্যন্ত। সর্বশেষ তিনি ১৯৯১ সালে ফেনী-৩ (সদর-সোনাগাজী) আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হয়ে বিএনপি প্রার্থী মাহবুবুল আলম তারার সঙ্গে হেরে যান।

পৃথিবীতে কোন মানুষই মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারেনা। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা মরেও মানুষের কাছে হাজার বছর বেঁচে থাকেন তাঁর কর্মের মাঝে। প্রয়াত তালেব আলী ছিলেন এমনই একজন, যিনি তাঁর আদর্শের মাঝে বেঁচে থাকবেন। ক্ষণজন্মা এই গুণী মানুষটির শেষ বিদায়ে গভীর শ্রদ্ধা। মহান আল্লাহ ভুলত্রুটি ক্ষমা করে তাঁর সৎকাজের প্রতিদান স্বরূপ জান্নাত নসীব করুন। প্রয়াত তালেব আলী সৎ রাজনীতিকের আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!