ফ্রেন্ডস এখন প্লে করছি ২১ শে ফেব্রæয়ারির স্পেশাল ট্রাক আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রæয়ারি তো শুনতে থাকো আর এনজয় করো অ্যান্ড অফ কোর্স একুশের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করো।’ কী চমৎকার মস্করা!
এটা একটা বেসরকারি রেডিও-এর ঘোষণা। বাংলা ভাষার গৌরব যে ভাষা আন্দোলন, সে অনুষ্ঠানেও ভাষার চরম বিকৃতি! আজ বেসরকারি রেডিওগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে বিকৃত বাক্য ও শব্দ ব্যবহার করে চলছে। এসব রেডিওতে ‘রেডিও জকি’ নামে একটি চরিত্র তৈরি হয়েছে, যারা এই বিকৃতি করছে। এদের বাংলা উচ্চারণ ইংরেজির মতো। আরো একটি উদাহরণ দেই-
‘হ্যালো ফ্রেন্ডস, কেমন আছ তোমরা? হোপ দিস উইকে তোমরা ম্যানি ম্যানি ফান করেছ, উইথ লটস অফ মিউজিক। অ্যনিওয়ে, এখন তোমাদের সাথে আছি কুল ফ্রেন্ড জারা অ্যান্ড আছে জোশ সব মিউজিক ট্রাক অ্যান্ড লটস আড্ডা, সো ফ্রেন্ডস ঝটপট জয়েন করে ফেলো আমাদের আড্ডায় এন্ড ফেবারিট গান শুনতে মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে লিখো ।’বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে, নাটকে, সিনেমায় অর্থাৎ গণমাধ্যমে এখন ভাষা বিকৃতির যেন উৎসব চলছে। এখন এমন কিছু বিকৃত শব্দ ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা মৌখিকভাবে ব্যবহার করছে, যে ভাষা না আঞ্চলিক, না প্রমিত। শুদ্ধ-অশুদ্ধের মিশেলে সে এক অন্য ভাষা। কিছু উদাহরণ :
১. প্রমিত বাংলায় ‘এসেছ’, শিক্ষার্থীরা বলছে ‘আসছ’, ২. ‘করেছিস’-কে শিক্ষার্থীরা বলছে ‘করছিস’, এভাবে : ৩. ‘তাহলে’-কে ‘তাইলে’, ৪. ‘পাঁচটা’-কে ‘পাসটা’, ৫. ‘খরচ’-কে ‘খরছ’, ৬. ‘ধরে’-কে ‘ধইরা’, ৭. ‘কেন’-কে ‘ক্যা/ক্যান/কিয়াল্লাই’, ৮. ‘কাকে’-কে ‘কারে’, ৯. ‘কোথায়’-কে ‘কই’, ১০. ‘ওটা’-কে ‘ওইটা’, ১১. ‘ওগুলো’-কে ‘ওইগুলা’ বলছে শিক্ষার্থীরা।
তরুণ প্রজন্ম বিকৃত করে শব্দ উচ্চারণ করছে বেশি। শুধু আধুনিকতার দোহাই দিয়ে তারা এটা করছে। এতে গণমাধ্যমের প্রভাব বেশি। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন, নাটক ও চলচ্চিত্রে বিশেষ করে বিকৃত ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের কথা যেমন—‘খাইলেই দিশ খোশ’, ‘এক্সট্রা খাতির’, ‘আবার জিগায়’ ইত্যাদি এখন তরুণ তরুণীদের মুখে মুখে। কিছু নাটকের নাম এবং সংলাপে দেখা যাচ্ছে বিদেশি শব্দের ছড়াছড়ি। যেমন- ফার্স্ট ডেট, হাইজফুল, ছাইয়্যা ছাইয়্যা, লাভ ডট কম, সিটি বাস ইত্যাদি। নাটকের সংলাপে বলা হচ্ছে, মাইরের মধ্যে ভাইটামিন আছে, ফাইস্যা গেছি মাইনকার চিপায়, ফিল্মি কথা বাদ দাও, এক্সটা খাতির নাই, ফিল্মি ডায়ালগ মারতাছ।
অবজ্ঞা ও বিরক্তি প্রকাশে তরুণ-তরুণীরা নতুন নতুন শব্দযুগল ব্যবহার করছে। যেমন- ১. মাঞ্জা মারা, ২. হুদাই প্যাচাল, ৩. তেলবাজ, ৪. চালবাজ, ৫. পল্টিবাজ, ৬. কুফালাগা, ৭. গুষ্ঠি কিলাই, ৮. তারছিড়া, ৯. বেইল নাই, ১০. মাইনকাচিপা, ১১. আরে মামু, ১২. প্যাচগি মারে, ১৩. সুইসাইড খামু, ১৪. আল্টামডান, ১৫. কইছে তরে, ১৬. যাইগা বাদ দে, ১৭. কঠিন চেহারা, ১৮. ঠ্যাক দিছে ইত্যাদি।
এ প্রজন্মের তরুণ দু’বন্ধুর কথোপথন দেখা যাকযারা আঞ্চলিক বা শুদ্ধ কথার বাইরে ভিন্ন ঢঙে কথা বলে। ‘‘আরে মাম্মা কোত্তে আইলি। তোরে তো সারসাইতে সারসাইতে (সার্চ-খোঁজা) আমার অবস্থা খারাপ। ফোনটাও অফ করে রাখছোস। পরে তোর জিএফ’রেও ফোন দিছি। ও তো কইলো তুই ওর সাথেও ছিলি না। কই আছিলি ক’তো?’’
বন্ধু জবাব দেয়, ‘‘আর কস না মামা, এই জিএফটাকে নিয়ে ব্যাপক প্যানার মইধ্যে আছি। এমতে ক্লাস, এক্সাম নিয়ে আছি দৌরের উপ্রে, তার ওপর আবার জিএফ’র প্যানা। মাঝে মইদ্যে মুঞ্চায় ব্রেকআপ কইরা ফালাই।’
এখানে ভাষার সংক্ষিপ্তকরণ ও উচ্চারণের বিকৃতি এবং বিদেশি শব্দের মিশ্রণ ঘটেছে। বিশেষ করে বর্তমানে বন্ধুকে সম্বোধনের একটি ‘জনপ্রিয়’ ডাক হল মাম্মা মানে মামা। এছাড়া প্রেমিকাকে সংক্ষেপে বলা হয় জিএফ (গার্লফ্রেন্ড), প্যানা অর্থ বোঝায় বিভিন্নভাবে বিরক্ত করা বা অধৈর্য করা। মুঞ্চায় অর্থ মন চায়, দৌরের উপ্রে অর্থ দৌড়ের উপরে সহজ অর্থ ব্যস্ততা। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এমন হাজার হাজার শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে যার বিস্তৃতি ঘটছে এক মুখ থেকে অন্য মুখে। আভিধানিকভাবে এ সব ভাষা বা শব্দ স্বীকৃত না হলেও তার প্রভাব দেখা যায় দেশের বর্তমান ধারার নাটক ও টেলিফিল্মগুলোতে। আর সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হচ্ছে গভীর রাতে এফএম রেডিওগুলোর আরজেদের (রেডিও জকি) কথোপকথনে।
বর্তমার তরুণ সমাজ এবং ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া যে ভাষা ব্যবহার করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সে ভাষার নাম দেন বাংহিংলিশ। তারা হিন্দি ও ইংলিশকে বাংলার সাথে এমনভাবে মিশিয়ে কথা বলছে যেন ভাষার নতুন একটি রূপ তৈরি হয়েছে। তিনি লেখেন, ”কিন্তু এভাবেই যদি বাংলা ভাষা এগোয়, নদীর মতো অবধারিতভাবে, তা হলে বাংলা ভাষার আরেকটা নাম আমাদের তৈরি করে নিতে হবে। এর নাম আমরা বাংহিংলিশ বা এ রকম কিছু দিতে পারি, যেহেতু বাংহিংলিশে বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দির একটা চমৎকার সহঅবস্থান রয়েছে। এতে সুবিধা হবে, শুধু ফেব্রæয়ারি মাসটা এলে আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে ভাবব, বাকি এগার মাস বাংহিংলিশের সেবায় নিয়োজিত থাকব।” (ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী, প্রথম আলো, ১৫.০২.২০১২)
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ অভিনব ভাষার ৩টি উদাহরণ পেশ করেন :
১. ঢাকার স্টক মার্কেট-বিপর্যয় এখন অনেকের কাছে উদ্বেগের কারণ। এরকম এক উদ্বিগ্ন স্টক-মার্কেট বিশেষজ্ঞ একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বললেন ‘স্টক মার্কেট ক্রাইসিসের রিজনগুলো ইনভেস্টিগেট করতে হবে। যেসব বিগ এ্যাক্টর ও প্লেয়ার ব্যাকগ্রাউন্ডে রোল প্লে করছে, যাদের নাম ইব্রাহিম সাহেব তাঁর রিপোর্টে রিভিল করেছেন, তাদের প্রপার পানিশমেন্ট দিতে হবে।’
২. কলাভবনে আমার কক্ষের বাইরের বারান্দায় দাঁড়ানো কিছু ছেলেমেয়ে খুব গÐগোল করছিল। আমি বেরিয়ে তাদের কারণ জিজ্ঞেস করলে একটি মেয়ে বলল, ‘স্যার, আমাদের টিসার হঠাৎ ক্লাস পসপোন করে দিছে। সে তো একটা নোটিশ দিলে পারত।’
আমি আর ভয়ে শিক্ষকের নাম জিজ্ঞেস করলাম না। আমার থেকে বয়সে বড় শিক্ষকও অনেক আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে!
৩. একটি এফএম রেডিও থেকে এক আরজের আপ্লæত আহ্বান শোনা গেল এক দুপুরে, ‘ফ্রেন্ডসরা, এই অফার কিন্তু ভ্যালিড টিল ফর্টিনথ। সো মনে রেখো। লাইক ইটস আ ফাটাফাটি ইভেন্ট। সো সেন্ড করোৃ’ (ঐ)
উপরোক্ত উদাহরণসমূহে সাম্প্রতিক বাংলা ভাষা ব্যবহারের চিত্র ফুটে ওঠেছে। সমাজের এ তিন শ্রেণির মধ্যেই ভাষার চরম বিকৃতি ঘটেছে, যা ভীষণ আতঙ্কের ব্যাপার।
তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষার সঙ্গে বিদেশি ভাষার মিশ্রণ, শব্দের উচ্চারণ ও ব্যবহারে বিকৃতি করে নতুন যে ভাষার উদ্ভব ঘটিয়েছে; অনেকেই সে ভাষাকে বলছে এফএম ভাষা, কেউ বলছেন শর্টকাট ভাষা, আবার কেউ বলছেন ভাই-ব্রাদারের ভাষা। নতুন প্রজন্ম বলে, আমরা বন্ধুদের মধ্যে যে ভাষায় কথা বলি এটা একটা স্টাইল। অনেকে একে এফএম ল্যাঙ্গুয়েজ বলে। আবার ভাই-ব্রাদার ল্যাঙ্গুয়েজও বলে। ভাই-ব্রাদার ভাষা প্রসঙ্গে বলা হয়, মূলত আজিজ সুপার মার্কেটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নাট্য জগতের একটি উত্থান হয়েছে। এখানে দেশের একজন চলচ্চিত্র ও নাট্যপরিচালক এবং তার জুনিয়র বন্ধুদের বলা হয় ভাই ব্রাদার। তারা সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের জন্য যে সব নাটক বানাচ্ছে সেগুলোতে এ ধরনের ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। আর এ সব নাটক বেশ জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে।
এত গেল তরুণ প্রজন্মের কথ্য ভাষার বিকৃত রূপ। ফেসবুক, টুইট, মুঠোফোনের খুদে বার্তা ও বøগের মত সামাজিক মাধ্যমে ইংরেজি বর্ণ ব্যবহার করে বাংলা ভাষা ও ইংরেজি ভাষার যে বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে তা আশঙ্কাজনক। দশ-বারো বছর আগে চ্যাটিং খুব জনপ্রিয় ছিল। সে সময় তরুণরা সাইবার ক্যাফে বসে বসে শুধু চ্যাটিং করতো। সেহেতু টাইপ করে উত্তর দিতে হতো, তাই শব্দকে সংক্ষেপে প্রকাশ করতো। যেমন, ঢ়ষু= ঢ়ষবধংব, ধংষ= ধমব ংবী ষড়পধঃরড়হ, ন৪= নবভড়ৎব, নপ= নবপধঁংব, ঁ= ুড়ঁ, নভ=নড়ু ভৎরবহফ, মভ= মরৎষ ভৎরবহফ ইত্যাদি। পরবর্তীতে মোবাইল ম্যাসেজও এভাবে লেখা শুরু হয়। আর সবচেয়ে আপত্তিকর ব্যাপার হলো কথাবার্তায় এমন সংক্ষিপ্ত রূপ দেয়া। যা এখন শুরু হয়ে গিয়েছে। এতে পুরো ভাষাটাই পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। যেমন, তোর সিসের খবর কি? এখানে সিস মানে সিসটার, তেমন ব্রো মানে ব্রাদার ইত্যাদি।
ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তির ওয়াল লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিচিত্র রকম মন্তব্য। যেগুলোর ভাষা বুঝে ওঠা খুবই কষ্টকর। যেমন অনেকেই ভ৯, ৎ৮, ঃপ, পি, ২সব, ঃহী, এ ধরনের সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহার করে। যদি কারো এ সব শব্দ সম্পর্কে ধারণা না থাকে তাহলে সে কিছুই বোঝবে না। উপরের সংক্ষিপ্ত ইংরেজি শব্দগুলো দিয়ে বোঝানো হয়েছে ফাইন, রাইট, টেক কেয়ার, ওয়েলকাম, তুমি, থ্যাংকস।
যদি কেউ অন্যের ওয়ালে এভাবে লেখেন,2me amr ballo bondo, onk din tmr sate daka hai na. amk tomi bole gale na. manas ato sattapar hai.
এই ইংরেজি বর্ণ ব্যবহার করে সৃষ্ট বাংলা ভাষাটা অনেকেই পড়বেন এভাবে, ”২মি এএমআর বাল্ল বন্ধু, ওনক দিন টিএমআর স্যাট ডাকা হায় না। এএমকে টমি বোল গেলে না. মানাস অটো সাটাপার হায়।’’ আসলে লেখা হয়েছে, ”তুমি আমার বাল্য বন্ধু, অনেক দিন তোমার সাথে দেখা হয় না। আমাকে তুমি বলে গেলে না। মানুষ এত স্বার্থপর হয়।” নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে এ সব কোড বা সংক্ষিপ্ত ভাষা খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যদি কেউ এ সব ভাষা না বুঝে তাহলে সে অন্যদের কাছে হয় ক্ষ্যাত না হয় আঁতেল।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এই মার খাওয়া ভাষা তো মুখের ভাষা, এ তো লিখিত নয়, তাহলে এত ভাবনা কেন? এর উত্তরে বলা যায়, যে জাতির মুখের ভাষা এখন মার খাওয়া, শংকর শ্রেণীর, সে জাতির লেখার ভাষাও দুর্বল হয়ে পড়ে, কারণ এর ব্যবহারকারীদের চিন্তাও তখন অস্বচ্ছ হয়ে পড়ে। এর নমুনা তো ইতোমধ্যেই দেখছি।
পরিশেষে বলতে চাই আমাদের বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ, সঠিক শব্দচয়ন ইত্যাদি বিষয়েও আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ সাইট যেখানেই ভাষা ব্যবহার করি না কেন, একটু বিনোদনের জন্য তা যেন ভাষার দূষণে ভূমিকা না রাখে। রোধ করতে হবে ভাষার বিকৃতি ও দূষণ। কারণ ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’।
লেখক : ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।