কিশান মোশাররফ
ফেনী সদর উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের মধ্যম ছনুয়া এলাকার মোল্লা বাড়ীর প্রতিবন্ধী নারী (৩২) সোমবার দুপুরে গ্রামে ভিক্ষাবৃত্তি করে বাড়ি ফিরছিল। পথিমধ্যে একই এলাকার মো: মোস্তফার ছেলে টমটম চালক কবির আহম্মদ (৫০) তাকে রাস্তায় একা পেয়ে জোরপূর্বক তার নতুন বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে।
দৈনিক ফেনীর সময় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, পরবর্তীতে এলাকার কয়েকজন ব্যক্তিসহ ধর্ষণের শিকার প্রতিবন্ধী নারী বিষয়টি স্থানীয় মহিলা মেম্বার নুর নাহারকে অবহিত করেন। নুর নাহার বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান করিম উল্যাহ বি.কমকে জানালে মঙ্গলবার কবির আহমদকে পরিষদে ডেকে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সন্ধ্যায় তিনি এলাকার লোকজনের উপস্থিতিতে শালিসী বৈঠকে কবির আহমদের ৩০ হাজার টাকা জরিমানার রায় প্রদান করেন। শালিসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নগদ ৫ হাজার টাকা ও পরে রাতে বাকি ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেন কবির। সংবাদে আরো উল্লেখ ছিল, আদায়কৃত জরিমানার টাকা নির্যাতিতা নারীর হাতে পৌঁছেনি।
প্রকাশিত সংবাদে জানতে পারি, সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের সাথে অভিযুক্ত কবির আহমেদের কথা হয়। কবির আহমদ জানিয়েছেন, “আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তবুও জরিমানার ৩০ হাজার টাকা সালিশদার স্থানীয় নুর করিমের কাছে মঙ্গলবার রাতে পরিশোধ করি।”
তবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান করিম উল্যাহ বি.কম বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি জানান, জরিমানার টাকা মাত্র ৫ হাজার পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি বরং বিষয়টি জানাজানি হওয়ার জন্য সাংবাদিকদেরকেই উল্টো দোষারোপ করেছেন।
ভিক্ষা করে ফেরার পথে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে এটা জানাজানি হওয়ার পর যতটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদে শালিস করে ঘটনাটি মিমাংসা এবং আদায়কৃত জরিমানার টাকা নয়ছয় করার বিষয়টি আরো বেশি সমালোচিত হয়েছে। ধর্ষনের মত ঘটনা বিচার ইউনিয়ন পরিষদে করতে পারে কিনা এনিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
পত্রিকার খবরে জানতে পারি, সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: হাসানুজ্জামান কল্লোলের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় চেয়ারম্যান করিম উল্যাহ ওই ঘটনার বর্ণনা দেন। সভায় তিনি জানান, ওই প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে তার কাছে বিচার চাইতে আসেনি। তবুও তিনি খবর জেনে লোক পাঠিয়ে ধর্ষনে অভিযুক্ত টমটম চালক কবিরকে ইউনিয়ন পরিষদে এনে আটকে রাখেন। একপর্যায়ে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেন। ওই সভাতেও তিনি সমালোচনা করেন সাংবাদিকদের। অবশ্য একইসভায় তিনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও এক হাত নেন। ওইদিন থেকেই বিষয়টি বেশি আলোচনায় আসে। তার বক্তব্য জেনে সাংবাদিকদের মাঝেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তার চেয়েও বড় কথা একজন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা প্রকাশ হওয়ার একসপ্তাহ পার হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিলেন, তার তথ্য পাওয়া যায়নি। ধর্ষনের বিষয়টি যেহেতু ইতিমধ্যে যথেষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে সেক্ষেত্রে পুলিশ মামলা নিতে বাধা কোথায় ?
এ বিষয়ে জানতে ফেনীর সময় এর পক্ষ থেকে কথা হয় ফেনীর পুলিশ সুপার জাকির হাসান এর সঙ্গে। তিনি বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার কিংবা সমাজের কোন গণ্যমান্য ব্যাক্তি ধর্ষণের মত ঘটনার বিচার বা আপসরফা করার ক্ষমতা রাখেননা।
অভিন্ন মত ফেনীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট অভিষেক দাশ এর। তিনি বলেন, আদালত ব্যতিত অন্য কোথাও ধর্ষনের বিচার আইনসঙ্গত নয়।
ঢাকার অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ সঞ্জিব দাসের মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ধর্ষণের ঘটনা একটি ফৌজদারী অপরাধ। এখানে আইনের প্রতি অবজ্ঞা ও চরমভাবে আইন অবমাননার ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই স্পর্শকাতর বিষয়। ভুক্তভোগী নারীর মেডিকেল পরীক্ষা, আলামত সংগ্রহ ও তার আইনি সহায়তা প্রাপ্তির জায়গা বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। অপরপক্ষে অপরাধীকে থানা পুলিশে সোপর্দ করার পরিবর্তে কিছু টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার মাধ্যমে আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শিত হয়েছে। যা সমাজ ও রাষ্ট্রে ভুল বার্তা দিবে। এতে পরোক্ষভাবে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে।
কোন ক্ষমতাবলে একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ধর্ষণের মত ঘৃণ্য ঘটনার বিচার ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে জনসম্মুখে করতে পারেন ?
লেখক : চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।