ফ্যাসিবাদের দিনলিপি (পর্ব-৪)
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামীলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা পালিয়ে গেলেও সাড়ে ১৫ বছরের জুলুম-নির্যাতনের কথা মনে উঠলে স্মৃতিকাতর হন বিরোধী রাজনীতিকরা। দীর্ঘদিন আড়ালে-আবড়ালে থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে এখন রাজনীতির মাঠে সদর্পে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। গায়েবী মামলা, গ্রেফতারের আশংকায় নির্ঘুম রাত কাটানোর অসংখ্য দু:সহ স্মৃতি রয়েছে তাদের। দীর্ঘসময়ে জামায়াতে ইসলামীর ফেনী জেলা আমীর ছিলেন -একেএম সামছুদ্দীন।
ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্বে ফেনীর সময় এর সঙ্গে তার কথোপকথন।
আরিফ আজম :
“২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত্ েইসলামীর সহকারি সেক্রেটারী আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দিয়েছিল। এ খবরে ফেনীতে ছাত্র-জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুদ্ধ হয়ে তারা রাস্তায় মিছিল করে। সেদিন রাতে মিছিলে তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম গুলি করলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা ও আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া মাদরাসার ছাত্র হাফেজ আবদুল্লাহ আল সালমান শহীদ হন। পরদিন ফালাহিয়া মাঠে জানাযা শেষে ফুলগাজীতে দাফন করা হয়। এরপর শহরে ব্যাপক আন্দোলন করে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা। ওই ইস্যুতে জামায়াত অফিসে আগুন দিয়েছে। গাড়ী জ¦ালিয়ে দিয়েছে। নির্মাণ সুপার মার্কেটেও আগুন দেয়।”
বিভীষিকাময় দিনের স্মৃতি রোমন্থন করেন জামায়াতে ইসলামীর সদ্য সাবেক জেলা আমীর একেএম সামছুদ্দীন। আওয়ামীলীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের বেশিরভাগ সময়ে ২০১৩ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
একেএম সামছুদ্দীন বলেন, “কাদের মোল্লাকে ফাঁসির রায় কার্যকরের দিন সারারাত রাস্তায় কেটেছে। ২০১৫ সালে পুলিশ সুপার হয়ে এসেছিলেন রেজাউল করিম। তিনি আসার পর পুরো জেলার দায়িত্বশীল সবার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। তার সময়ে ব্যাপক টর্চার করেছে।”
তিনি আরো বলেন, “আদালতে মিথ্যা মামলায় হাজিরা দিতে গেলে সেখান থেকে গ্রেফতার করে। তখন কারাগারে দ্বিতীয় তলায় রাখা হয়। সেখানে ১শ জন লোক ছিল। তাদের জন্য একটি মাত্র বাথরুম। একটা মাত্র মামলা দিয়ে ৭ মাস কারাগারে রেখেছে। হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলে জেল গেট থেকে শোন অ্যারেষ্ট করা হয়। এভাবে ১৫ বার গ্রেফতার করা হয়। যতবার জামিন হয় ততবার পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। ২০১৩ সালের ফেনীতে যত তান্ডব হয়েছে তার জন্য ছাত্রশিবিরের শহর সভাপতি তারেক মাহমুদ ও আমার ছেলে হামীমকে ক্রসফায়ারের সিদ্ধান্ত নেন এসপি রেজাউল। সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে তাদের দুইজনকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিই।”
‘রাষ্ট্রীয় হয়রানীর চিত্র’ তুলে ধরে বলেন, “২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগমুহুর্তে ধরপাকড় শুরু হয়। তখন এক-দুইমাস আগ থেকে বাসা ছেড়ে দিয়েছি। ঢাকা থেকে এসে সাংগঠ্িনক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম করেছি। পাশাপাশি নেতাকর্মীদের জামিন করানো হতো। বিভিন্ন সময় পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করে মিছিল-মিটিং করতে হয়েছে। প্রতিদিন রাত ২টার পর বাসায় পুলিশ অভিযান চালাতো। ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর বাসার সামনে থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সেবার একমাস জেল খেটে ২১ ডিসেম্বর জামিনে বের হই। ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে দারুল ইসলাম ভবনে ঈদ পূর্নমিলনী ছিল। ওই অনুষ্ঠানে ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু অতিথি ছিলেন। আমরাও ছিলাম। পুলিশ টের পেয়ে ঘেরাও করে অভিযান চালায়। ভবনের তিন তলা থেকে ঝুঁকি নিয়ে লাফ দিয়ে পাশ্ববর্তী ভবন হয়ে সরে পড়ি। দুইবার এমন পরিস্থিতির শিকার হই। কখনো ভাবিনি এভাবে লাফ দিয়ে পার হতে পারবো। মনে পড়লে এখনো ভয়ে আঁতকে উঠি। তখন থেকে মারাত্মক হাটু ব্যাথায় ভুগছি।”
পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে সব কর্মসূচী পালন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দেখামাত্র গুলির নির্দেশও ছিল। তবুও কোন কর্মসূচী বাদ যায়নি। কোন মিছিলে সংখ্যায় উপস্থিতি কম ছিল কিংবা বেশি ছিল। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা জীবনবাজি রেখে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়েছে।”