ফারুক আহমদ শামীম
ইসলাম আমাদেরকে গতানুগতিক কোনো স্বাধীনতার ধারণা দেয়নি। ইসলাম মানবতার সামগ্রিক জীবনে মুক্তি, সাম্য ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার বাস্তব ও যথার্থ কর্মসূচী দিয়েছে এবং মানুষের সৎ বৃত্তিগুলোর অবাধ বিকাশের মধ্য দিয়ে সত্যচর্চার পথ উন্মুক্ত করতে চেয়েছে। ইসলাম প্রতিটি বিষয়ে আমাদেরকে যথার্থ দিকনির্দেশনা দেয়। স্বাধীনতার মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও আমরা ইসলামের দিকনির্দেশনা পাই। মুসলিম উম্মাহ আজ বড় কঠিন দুঃসময় অতিক্রম করছে। বহুমুখী বিপর্যয়ের প্রধানতম একটি দিক হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আজ বিপন্ন। মুসলিম বিশ্বের করুণ মুখচ্ছবির দিকে তাকালে এ কথা গল্পের মতো মনে হয় যে, এজাতি একদিন বিপুল শৌর্যে-বীর্যে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে বিজয় ও নেতৃত্বের গৌরবময় ইতিহাস রচনা করেছিল। প্রচলিত ধারণায় স্বাধীনতা বলতে কোনো দেশের ভৌগোলিক নিজস্বতাকেই বোঝায়। কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, শুধু ভৌগোলিক নিজস্বতা পূণার্ঙ্গ স্বাধীনতা নয়।
সংক্ষেপে ইসলামে স্বাধীনতার মর্ম হল সর্বপ্রকার অসাম্য ও অনাচার দূর করে ন্যায়নীতি ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সত্যগ্রহণ ও সত্যচর্চার অধিকার লাভ। পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত স্বাধীনতার উল্লেখিত মর্মের প্রতি ইঙ্গিত করে। মানব সভ্যতার কলঙ্ক অত্যাচারী ক্ষমতাধর ফেরাউন মানবতাকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখে তাদের স্বাধীনতাকে হরণ করে নিয়েছিল। মহান আল্লাহ সে প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, “নিশ্চয় ফেরাউন ভূমিতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল এবং সেই ভূখন্ডের অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে রেখেছিল। সে তাদের একটি শ্রেণীকে দুর্বল ভেবেছিলেন এবং তাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করত ও কন্যা সন্তানদেরকে জীবিত থাকতে দিত। বাস্তবিকই সে ছিল নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী। আর আমার অভিপ্রায় ছিল প্রদমিতদের প্রতি অনুগ্রহ করব এবং তাদের নেতা বানিয়ে দেব আর তাদেরকে পৃথিবীর শাসক বানিয়ে দেব এবং ফেরাউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে (লাঞ্ছনা ও পরাজয়ের) সেসব বাস্তবতা দেখাব যা থেকে তারা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখছিল। (সূরা কাসাস ৪-৫)
উপরোক্ত আয়াতের সারকথা এই দাঁড়াল যে, শোষিত ও মজলুমদের জাগ্রত করা হবে এবং স্বৈরাচারী দাম্ভিক শক্তিকে প্রতিহত করা হবে, যাতে পৃথিবীর মানুষ মুক্তি পেতে পারে এবং সত্যচর্চা ও সত্যগ্রহণের অধিকার লাভ করতে পারে। স্বাধীনতার এই যদি অর্থ হয় (নিঃসন্দেহে এটাই স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ) তাহলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায় যে, বিশ্ব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে এ স্বাধীনতা ও তা অর্জনের বাস্তবিক ও নৈতিক কর্মসূচি পূণার্ঙ্গরূপে একমাত্র ইসলামই দিয়েছে। ইসলামের স্বর্ণযুগগুলোতে তার পূণার্ঙ্গ প্রতিফলন ও তার সুফলও ইসলাম দেখিয়ে দিতে পেরেছে। আমরা স্বীকার করি যে, পৃথিবীর কোনো ধর্মবা মতাদর্শ মানুষকে গোলামীর শিক্ষা দেয় না। তবে এসত্যকেও অস্বীকার করা যাবে না যে, মানুষকে আযাদীর চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার পর পূণার্ঙ্গ আযাদীর পরিপূর্ণ কর্মসূচি ইসলাম ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম বা মতাদর্শ দিতে পারেনি। যে যাই দাবি করুক না কেন মূলত ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মে বা মতাদর্শে সার্বিক স্বাধীনতার সে ন্যায়ানুগ কর্মসূচি ও নীতিমালাই নেই যা দ্বারা স্বাধীনতার প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কল্যাণ পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হতে পারে।
গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ : গভীরভাবে ভেবে দেখলে সত্য স্পষ্ট হয় যে, প্রকৃত স্বাধীনতা তাকেই বলা যায় যে স্বাধীনতা লাভের পর পরাধীনতা ও পরাধীনতাজাত অনাচার থেকে সার্বিকভাবে মুক্তি পওয়া যায়। আর তা কেবল সম্ভব হতে পারে মন ও মনন এবং চিন্তা ও বিবেকের রাহুমুক্তির মধ্য দিয়ে। যাতে মানুষ যা কিছু উপলব্ধি করতে চায় তা প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে যৌক্তিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে। মানবতার আযাদীর সকল ধারা অন্তর ও বিবেকের এই স্বাধীনতার উপরই নির্ভর করে। চিন্তা ও বিবেকের এ স্বাধীনতা পেলে সমগ্র পৃথিবীতেই মানুষ স্বাধীন আর এই স্বাধীনতা না পেলে সমগ্র পৃথিবীতেই সে পরাধীন। সারা পৃথিবীতে সে গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ।ইসলাম মানবতার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছে। তাই চিন্তা ও বিবেকের উপর থেকে মিথ্যা ও অজ্ঞতার আবরণ অপসারণ করে তার অবাধ সঞ্চলনের পথ করে দিয়েছে। অতঃপর মানব বিবেককে এতদূর স্বাধীনতা দিয়েছে যে, স্বয়ং ইসলাম ধর্ম মেনে নেওয়ার জন্যও কোনোরূপ চাপ প্রয়োগ সমর্থন করেনি। প্রত্যেকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দিয়ে ইসলাম ঘোষণা করেছে, ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে কারো প্রতি চাপ প্রয়োগ করা যাবে না।ইসলাম একমাত্র সত্য ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও তা গ্রহণের ব্যাপারে চাপ প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়নি। মহান আল্লাহর অভিপ্রায় হচ্ছে মানুষ মুক্ত বিবেকে আন্তরিকভাবে সত্য ধর্মকে অবলম্বন করুক। এভাবে ইসলাম মানবতাকে বিবেকের সবোর্চ্চ স্বাধীনতা প্রদান করেছে।
মন-মননে স্বাধীনতা : বিবেকের স্বাধীনতা প্রদানের পর চিন্তা ও বিবেচনা ভিত্তিক মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্ন দেখা দেয়। অন্তর ও বিবেক যে বিষয়টিকে সঠিক ভাবছে সে বিষয়টির অবাধ প্রকাশাধিকার না থাকলে বিবেকের স্বাধীনতা প্রদানের কোনো অর্থ হয় না। তাই এ ক্ষেত্রেও ইসলাম তার ঔদার্য প্রদর্শন করেছে। ইসলাম মানুষকে তার চিন্তা ও বিবেচনাভিত্তিক মতামত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে এবং এ ব্যাপারে কাউকে বাধা প্রদানের অধিকার দেয়নি। কোনো জাতি স্বাধীন হতে চাইলে প্রথমে তার মন মনন স্বাধীন হতে হবে। যে জাতির মন মননে যে ধরনের স্বাধীনতার বীজ ছড়ানো থাকবে সে জাতির আযাদী বিপ্লবও হবে সে ধরনের। এ জন্যে ইসলাম প্রথমে মানুষের মন-মননে স্বাধীনতা ও সাহসিকতার কেন্দ্র তৈরি করেছে যে কেন্দ্রের উপর ভর করে সে সামগ্রিক স্বাধীনতা অর্জন করে নিতে পারে।
স্বেচ্ছাচারিতা নয় : ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা ও ভারসাম্যও লক্ষ করার মতো। ইসলামে স্বাধীনতা মানে কখনই স্বেচ্ছাচারিতা নয়। স্বাধীনতার অর্থ হল সকল অসত্যের নাগপাশ হতে মুক্ত হয়ে সত্যের আনুগত্য গ্রহণ এবং মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল শক্তির কতৃর্ত্ব হতে সরিয়ে নিজেকে সত্যের কর্তৃত্বে সমর্পণ। অতএব স্বাধীনতার মর্ম ও চেতনা ব্যাখ্যায় বলগাহীন প্রগলভতার এতটুকু অবকাশ নেই ইসলামে। ইসলাম স্বাধীনতার সীমারেখা নিধার্রণ করে দিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার কুফল থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করেছে।
মুসলিম উম্মাহর আযাদী চেতনা : মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এবং মুসলিম বিশ্বের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে অশুভ নীলনকশা প্রণয়নের পর ইতিমধ্যেই তার বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। সন্ত্রাসে মদদ দানের মিথ্যা অভিযোগ তুলে অমানবিক বর্বরতার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক ইসলামী সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র সংরক্ষণের মিথ্যা অজুহাত তুলে ইরাক দখল করে সে দেশের জনগণের উপর পৈশাচিক বর্বরতা চালানো হচ্ছে এবং সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে অন্যায়ভাবে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেখানে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে অবিবেচক ও সন্ত্রাসপ্রিয় শক্তি আমেরিকা ও তার দোসর রাষ্ট্রগুলোর সৈনিকরূপী হায়েনারা নারকীয় উল্লাসে মেতে উঠেছে। প্রতিনিয়ত সেখানে নিরীহ জনতার রক্ত ঝরছে। অবলা নারী আর নিষ্পাপ শিশুদের চিৎকারে ভারি হয়ে উঠেছে ইরাকের আকাশ-বাতাস। ফিলিস্তিনেও অবিরাম রক্ত ঝরছে। এভাবেই পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশ এখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আগ্রাসনের শিকার।আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের অবস্থাও খুব ভালো নেই। এ দেশের আকাশেও দেখা যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের কালো মেঘ।
বিভিন্ন ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত চলছে এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধেও। তবে মুসলিম বিশ্বের এ দু:সময়ে আশার কথা হল, মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতাকামী আদর্শবাদী শক্তিও নির্বিকার বসে নেই। শত ষড়যন্ত্র ও বিপর্যয়ের মুখেও তারা দেশে দেশে ঈমান ও আদর্শের অঙ্গীকারে সংগ্রামের পথে জাগ্রত। তারা একটি আদর্শের কাছে নিজেদের দায়বদ্ধ বলে বিশ্বাস করছেন এবং সেই দায়বদ্ধতা তাদেরকে জীবনপণ সংগ্রামে নিবেদিত রেখেছে। শত দুযোর্গের মধ্যেও একটি আশ্বাস তারা পৃথিবীকে দিতে চাইছেন। তা হচ্ছে ইসলামের যে চেতনা ও আদর্শ একবার মুসলিম উম্মাহকে মুক্তি দিয়েছিল, পরীক্ষিত সে চেতনা ও আদর্শই আজও মুসলিম উম্মাহকে মুক্তি দিতে পারবে। সে অভীষ্ট মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্যই তাদের এ সুকঠিন প্রত্যয়দীপ্ত সংগ্রাম।আজ মুসলিম বিশ্বের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে ইসলামের সামগ্রিক আযাদী চেতনায় তাদের র্নিভয়ে জাগ্রত হতে হবে। বিবেক-বিবেচনা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে জীবনের প্রতিটি স্তরে উপায় উপকরণের শক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের প্রচেষ্টা যেমন থাকতে হবে তেমনিভাবে ততোধিক গুরুত্বের সঙ্গে নিজেদের মধ্যে ঈমান ও আদর্শবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। মুসলিম উম্মাহর মুক্তির জন্য এবং তাদের সার্বভৌম স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ঈমান ও আদর্শবোধ উৎসারিত শক্তির কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : পরিচালক, দারুল আম্বিয়া হিফয মাদরাসা, ফেনী।