আরিফ আজম :
“কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি” ফেনী শহরের মিজান রোডের শহীদ জহির রায়হান হলের ফাঁকা মাঠ দেখলেই মনে পড়ে সুনীল গঙ্গোপধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি। ব্যবহার অনুপযোগি হওয়ায় ২০০৮ সালে ভেঙ্গে ফেলার দেড় দশক পরও পুন:নির্মাণ করা হয়নি। আধুনিকায়ন করে মাল্টিপারপাস হল পুন:নির্মাণে জনপ্রতিনিধিরা বহুবার আশ^াস দিলেও এটি বাস্তবায়ন হয়নি। জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদের বিশেষ প্রকল্পটি ফাইলবন্দি হয়ে আছে। জায়গা সংকটে এটি নির্মাণ কাজ থমকে থাকায় সংস্কৃতিপ্রেমী সহ জেলার বিশিষ্টজনদের মাঝে অসন্তোষ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ষাটের দশকে তৎকালীন মিজান রোডে ‘ফেনী টাউন হল’ প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হলেও কার্যত তা আর প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর তৎকালীন ফেনী মহকুমা প্রশাসক এম.আই. চৌধুরী এই টাউন হল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তৎকালীন নোয়াখালী জেলা বোর্ডের অধীনে ফেনী মহকুমা বোর্ডের (বর্তমান জেলা পরিষদ) ৪৩.৫০ শতক ভূমিতে ফেনী পৌরসভার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘ফেনী পৌর টাউন হল’। তবে এটি ফেনী মহকুমা বোর্ডের অধীনে থেকে যায়। ‘শহীদ জহির রায়হান’ এর স্মৃতিরক্ষায় ১৯৮২ সালে শহরের একমাত্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘ফেনী টাউন হল’ এর নাম পরিবর্তনের দাবী তোলেন। ১৯৮৪ সালে ফেনী মহকুমাটি জেলায় রূপান্তরিত হলে ফেনী জেলাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এর নাম ফেনী পৌর টাউন হল থেকে ‘শহীদ জহির রায়হান হল’ নামে নামকরণ করা হয়।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠকরা মনে করেন, ফেনী শহরের শিল্প সাহিত্য চর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল ‘শহীদ জহির রায়হান হল’। এটি ভেঙ্গে ফেলার ফলে ফেনীর শিল্প-সাহিত্য চর্চার এই প্রাণকেন্দ্রটির অভাবে এ অঞ্চলের সাহিত্য চর্চা স্থবির হয়ে পড়ছে।
সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক বিভিন্ন জেলায় অডিটোরিয়াম নির্মাণ প্রকল্পের চাহিদা অনুযায়ী ৮৭ শতাংশ জমি প্রয়োজন। কিন্তু ফেনী জেলা পরিষদের মালিকানাধীন হলের জায়গা রয়েছে ৪৩.৫০ শতাংশ। ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই তৎকালীন জেলা প্রশাসক মনোজ কুমার রায় এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে চিঠি প্রেরণ করেন। ওই চিঠিতে জেলা প্রশাসক মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং বাংলা শিল্প-সাহিত্যে শহীদ জহির রায়হানের অবদান ও ফেনীবাসীর সংস্কৃতি চর্চার উৎকর্ষ বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে জেলা পরিষদের প্রস্তাবিত ৪৩.৫০ শতাংশ জমিতেই নকশা পরিবর্তনপূর্বক বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে জহির রায়হান অডিটরিয়ামটি পুন:নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান।
সূত্রের তথ্যমতে, ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে ৫শ আসন বিশিষ্ট অডিটরিয়াম নির্মাণ করতে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল জেলা উন্নয়ন কমিটির সভায় ১ হাজার আসন বিশিষ্ট মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্স সহ বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ডিজাইন) এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১ হাজার আসন বিশিষ্ট মাল্টিপারপাস হল নির্মাণ করতে ১১২ শতক ও ৫শ আসনের জন্য ৬৮ শতক জায়গা প্রয়োজন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১১ মে পুন:নির্মাণে কনসালটেন্ট নিয়োগের প্রশাসনিক অনুমোদন পেতে তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছে চিঠি লিখেন জেলা পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান আজিজ আহম্মদ চৌধুরী। ওই বছরের ১ আগস্ট প্ল্যান, ডিজাইন ও প্রাক্কলন তৈরি করতে এলজিইডি প্রধান প্রকৌশলীকে চিঠি লিখেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জেলা পরিষদ অধিশাখার উপসচিব জুবাইদা নাসরীন। একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন জাহান স্থানীয় সরকার বিভাগে একটি চিঠি লিখেন। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মাল্টিপারপাস হল পুন:নির্মাণে ৫শ আসনের জন্য ৬৮শতাংশ জায়গা প্রয়োজন। এর মধ্যে ২৪.৫০শতাংশ জায়গা কম রয়েছে। তখন ৪শ আসন তৈরিতে ৬ কোটি ২৬ লাখ ১৬ হাজার ৪শ টাকার প্ল্যান, ডিজাইনও প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। পরের বছর ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি ৪শ আসনের পরিবর্তে ১ হাজার আসন বিশিষ্ট অডিটোরিয়াম কাম মাল্টিপারপাস হল পুন:নির্মাণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় জমির সংস্থান করে প্রকল্প প্রস্তাব প্রেরনের জন্য জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে অনুরোধ জানান উপসচিব আনজুমান আরা। সবশেষ ২০২৪ সালের ২১ এপ্রিল জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় বর্তমান জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার মাল্টিপারপাস হল নির্মাণের স্থান নির্বাচন করতে ৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ১৫ মে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা আক্তার তানিয়ার সভাপতিত্বে জেলা পরিষদে এ সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় জানানো হয়, জেলা পরিষদের অভ্যন্তরে সর্বমোট ৩.৭৫ একর ভূমি রয়েছে। এর মধ্যে ভাষা শহীদ সালাম কমিউনিটি সেন্টার এর পূর্ব পাশে পুকুর, চলাচলের মূল রাস্তা এবং পূর্বতন জহির রায়হান টাউন হলের পরিত্যক্ত ভূমিসহ মোট ১.১৮ একর ভূমি রয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া গেলে পুকুর ভরাটপূর্বক দক্ষ স্থাপত্যবিদ ও প্রকৌশলী দ্বারা পর্যালোচনা করে উক্ত স্থানে জহির রায়হান মাল্টিপারপাস হলসহ বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করার প্রস্তাবনা সমন্বয় সভায় উপস্থাপনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
সাংস্কৃতিক সংগঠক জাহিদ হোসেন বাবলু ফেনীর সময় কে বলেন, শহীদ জহির রায়হান অডিটরিয়াম পুন:নির্মিত হলে ফেনী জেলার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দীর্ঘদিন ধরে এই অডিটোরিয়ামটি পুন:নির্মাণে সুশীল সমাজ ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের প্রাণের দাবি। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সবার মাঝে ক্ষোভ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা পরিষদের প্রশাসক গোলাম মোহাম্মদ বাতেন ফেনীর সময় কে বলেন, শহরে পুকুরের সংকট রয়েছে। পুরোনো জায়গায় মাল্টিপারপাস হল নির্মাণের জায়গা পর্যাপ্ত নেই। তাছাড়া মিজান রোড সংকির্ণ। সামনে হাসপাতাল, পাশে মাদরাসা ও মার্কেট রয়েছে। জেলা পরিষদের অভ্যন্তরে পুকুর ভরাট ও ডাক বাংলোর জায়গায় হল তৈরি হলে শহরে যানজট তৈরি হয়ে দূর্ভোগ বাড়বে। এক্ষেত্রে অন্য যেকোন জায়গায় জেলা পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নে জায়গা কিনে কিংবা অধিগ্রহণ করা যেতে পারে।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার ফেনীর সময় কে বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ডিজাইন অনুযায়ী জায়গা প্রয়োজন, সেখানে সেই জায়গা নেই। ডিজাইন পরিবর্তনের জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুকুর ভরাট না করে ডিজাইন পরিবর্তন করার সুপারিশ করা যেতে পারে। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে পুকুর ভরাটের অনুমতি পাওয়া যাবে কিনা সন্দিহান।। কমিটির পরামর্শ উপস্থাপন করলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।