কামরুজ্জামান পলাশ :
ধরা যাক, কোন একজন মহিলা ধর্ষনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষনের পর ভিকটিম মামলা দায়র করতে বিলম্ব করে কিংবা ধর্ষনের পর ভিকটিমকে হত্যা করা হয় যাতে করে কোন প্রকার আলামতের উপস্থিতি না পাওয়া যায়।অনেক সময় মামলা দায়েরে বিলম্ব ঘটে, তাই ভ্যাজাইনাতে শুক্রানুর উপস্থিতি কিংবা কোন প্রকার আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় না।তাহলে ঐ ভিকটিম কিভাবে ধর্ষনের অভিযোগ প্রমাণ করবে বা কিভাবে আদালত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবা?
এমনই এক ঘটনা গত ১১ নভেম্বর,২০২১ একটি জাতীয় দৈনিকে ‘৭২ ঘন্টা পর ধর্ষন মামলা যেন পুলিশ না নেয়ঃ আদালত’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।আদালত পর্যবেক্ষনে বলেন, ৭২ ঘন্টা পর ধর্ষনের আলামত পাওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হলো, ধর্ষনের আলামত নির্ধারন কি উপায়ে করা হয় বা আদৌ কি কোন যথাযথ আইনী নিয়ম আছে ? এইবার দেখে নেয়া যাক ধর্ষনের আলামত নির্ধারনে আইন কি বলে।
১. প্রচলিত আইন : আমরা পেনাল কোড ১৮৬০ এর ধারা-৩৭৫ লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে, ধারাটি ধর্ষণের সংজ্ঞা প্রদান করে। যাতে বলা হয়েছে যে,একজন পুরুষ একজন মহিলার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ধর্ষন অপরাধে অভিযুক্ত হবে যখন-
১ম : শারীরিক সম্পর্কটি মহিলাটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়।
২য় : শারীরিক সম্পর্কটি মহিলাটির সম্মতি ছাড়া হয়।
৩য় : শারীরিক সম্পর্কটি মহিলাটির সম্মতি নিয়ে হয়। কিন্তু সম্মতি মহিলাটিকে মৃত্যুভয় বা আঘাত করার ভয়ের মাধ্যমে নেয়া হয়।
৪র্থ : যৌন সম্পর্ক স্থাপনের সময় পুরুষটি বিশ্বাস করে যে সে ঐ মহিলাটির স্বামী নয়, কিন্তু মহিলাটিকে বিশ্বাস করানো হয় যে পুরুষটি তার আইন মোতাবেক স্বামী হয়।
৫ম : শারীরিক সম্পর্কটি মহিলাটির সম্মতি নিয়ে বা না নিয়ে হয়, যখন মহিলাটির বয়স ১৪ বছরের কম।
আবার, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এ ধারা-৯ এর উপধারা-১ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, যখন কোন ব্যাক্তি ১৬ (ষোল) বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে বিবাহ সম্পর্ক বহির্ভূত নারীটির সম্মতি ছাড়া ভয়, ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারনার আশ্রয় নিয়ে তাহার সম্মতি আদায় করে বা ১৬ (ষোল) বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তাহার সম্মতি নিয়ে বা সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষন হিসেবে গণ্য করা হবে।
২. কেস প্রিসিডেন্ট বা নজির :
২. ১. পটভূমি
ধর্ষনের আলামত নির্ধারনে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ কর্তৃক মঈনুল হক গং বনাম রাস্ট্র (২০০৪)৫৬ ডি এল আর প্রদত্ত রায়টি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।এই মামলাটি খুবই চাঞ্চল্যকর একটি মামলা। এই মামলাটি ইয়াসমিন ধর্ষন মামলা বা পুলিশ হেফাজতে ধর্ষন মামলা নামেও বেশ পরিচিত।
২. ২.মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
ইয়াসমিন নামক একটি ১৮ বছরের বালিকা ঢাকা থেকে দিনাজপুর ফিরছে। কিন্তু সে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়গামী বাসে উঠে যায়। তাই উল্লেখিত বাসের হেল্পার ভিকটিমকে (ইয়াসমিন) দদউধংয গরষব চড়রহঃদদ নামক একটি যায়গায় নামিয়ে একজন চায়ের দোকানীকে বলেন যাতে করে ভিকটিমকে একটি দিনাজপুরগামী বাসে উঠিয়ে দেন।পরক্ষনে একটি পুলিশের পিক-আপ ভ্যান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়, যাতে উপস্থিত ছিলেন অভিযুক্ত, কন্সটেবল অমরিতা লাল বর্মন, এ এস আই (অঝও) মঈনুল হক এবং কন্সটেবল আব্দুস সাত্তার এবং পিক-আপ ভ্যান থেকে নেমে ভিকটিমের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন।অভিযুক্তরা ভিকটিমকে তাদের সাথে পিক-আপ ভ্যানে উঠতে বলেন ও পরক্ষনে ভিকটিম তাদের কথামতোন পিক-আপ ভ্যানে উঠেন।পরেরদিন সকালে উত্তর গোবিন্দপুর ব্রাক অফিসের পাশে দদউধংয গরষশ গধযধ ঝধৎধশদদনামক স্থানে ভিকটিমের মৃত দেহ পাওয়া যায়। অভিযুক্ত এ এস আই মঈনুল হক একটি সাধারন ডায়রি লিপিবদ্ধ করেন এই বলে যে, ভিকটিম পুলিশের পিক-আপ ভ্যান থেকে লাফ দেয়।
২. ৩. মামলার আমলকৃত ধারা সমূহ :
নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান)আইন-১৯৯৫ এর ধারা ৬(৪) অনুযায়ী ১৯৯৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কোতোয়ালী পুলিশ কেস নং-৬ রুজু করার মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
২. ৪ আলোচনার বিষয় সমূহ
উক্ত মামলায় দুটি মেডিকেল রিপোর্ট দাখিল করা হয়। যেখানে ১ম মেডিকেল (পোস্টমোর্টেম)রিপোর্টটি অভিযুক্তদের অনুকুলে দেয়। পরপর্তীতে আবার (পোস্টমোর্টেম) মেডিকেল করা হলে সেটিতে অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অভিযুক্তরা তাদের অনুকুলে দেয়া (পোস্টমোর্টেম) রিপোর্টটির সুবিধা নিতে চাইলে আদালত বলেন,১ম (পোস্টমোর্টেম) রিপোর্টেও আঘাতগ্রস্থ ভ্যাজাইনা ও আঘাতগ্রস্থ স্থানে রক্তজমাট বাঁধা জনিত রিপোর্ট পাওয়া যায়। তাই এই ক্ষেত্রে আমরা মামলার উপকরনে এই ভিন্ন দুটি পোস্টমোর্টেম রিপোর্টের কোন সংধর্ষ পাইনি।
৩. মামলার পর্যবেক্ষন : এই ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আপীল আদালত যুগান্তকারী আলোচনা ব্যাখ্যা প্রদান করেন। আদালত বলেন ধর্ষন সংগঠন করার ক্ষেত্রে গবৎব চবহবঃৎধঃরড়হ রহ ঃযব গবসনৎধহড়ঁং চধংংধমব শুধুমাত্র পুলিঙ্গ ভ্যাজাইনার ঝিল্লিদ্বারে (ঁঃবৎঁং ঃড় াঁষাধ) প্রবেশ করানোই যথেষ্ঠ।
উপরন্তু আলাদত বলেন, ধর্ষন মামলা প্রমাণে যোনীপথে (ভ্যাজাইনাতে) শুক্রানুর (ঝঢ়বৎসধঃড়ুড়ধ) উপস্থিতি কিংবা কোন প্রকার আঘাত (ওহলঁৎু) বা কোন প্রকার দস্তাদস্তির চিহ্ন (গধৎশ ড়ভ ঠরড়ষবহপব) কিংবা সতীচ্ছদ পর্দা (ঐুসবহ) ছেঁড়া (ঞবধৎ) দেখানো বা প্রমাণের মোটেও প্রয়োজন নেই।
৪. মামলার ফলাফল :
হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক প্রদত্ত রায়টি পড়ে আমরা এই সিধান্তে উপনিত হই যে, হাইকোর্ট ডিভিশন যথাযথ পর্যালোচনা করেছে এবং এই ক্ষেত্রে আমাদের কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করার নেই।
৫. মামলায় রেফারকৃত নজিরসমূহ :
ঝযধয কযধহ াং ঝঃধঃব১৮ উখজ(ডচ)৯১; অনফঁৎ জধংযরফ ঠং ঝঃধঃব ২৭উখজ(অউ)১;গঁংষরসঁফফরহ ধহফ ঙৎং, ঠং ঝঃধঃব ৩৮ উখজ(অউ)৩১১; ঝধরফঁৎ জধযসধহ ঘবঁঃড়হ ধহফ ঙৎং. ঠং ঝঃধঃব ৪৫ উখজ ৬৬; ঝরৎধল গধষ ধহফ ঙৎং. ঠং ঝঃধঃব ৪৫ উখজ ৬৬৮ ;ঝযধযলধযধহ ইরংধিং ধহফ ঙৎং. ঠং ঝঃধঃব ১৯৮৮ ইখউ(অউ)১৫৪=৪০ উখজ (অউ)২৯ ধহফ ঝঃধঃব াং কযধফবস গড়হফধষ ১৯৯০ ইখউ(অউ)২২৮.
৬. উপসংহার :
উপরিউক্ত যুগান্তকারী রায়টি পর্যবেক্ষন করে দেখা যায় যে, রায়টি আমাদের দেশে ধর্ষন মামলা বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনা করার জন্য পথ-নির্দেশক হিসেবে ভূমিকা রাখবে। কেননা আমাদের দেশের প্রচলিত আইন এমনকি বিশেষ আইনেও ধর্ষন মামলার আলামত গ্রহন প্রক্রিয়ার কোন প্রকার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়নি। উক্ত মামলা বিজ্ঞ হাইকোর্ট বিভাগ ভিন্ন ধরনের ২টি পোস্টমোর্টেম রিপোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলনা করেন এবং পরিশেষে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।তাই উক্ত রায়টি ব্যাপকভাবে গুরুত্বপূর্ন।
লেখক : শিক্ষানবিস আইনজীবী
ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।