জাহাঙ্গীর আলম
আগস্ট মাস বাঙ্গালির জাতীয়জীবনে একটি নিকষকালো অধ্যায়ের নাম। এমাস এলে বাঙ্গালি হৃদয়ে নীরবে রক্তক্ষরণ হয়। মুহ্যমান শোকে নুয়ে পড়ে প্রকৃত দেশ প্রেমিক জনতা। করণ, এই মাসে সুপরিকল্পিত ভাবে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছিল তৎকালীন সেনাবাহিনীর কিছু বিশ্বাস ঘাতক। সেদিন ছিল ১৫ আগস্ট। উনিশ শ পঁচাত্তর সাল। এই দিন ঘাতকের দল সপরিবারে হত্যা করেছিল বাঙ্গালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে। যিনি পরাধীনতার শেকল ভেঙ্গে বাঙ্গালি জাতিকে কেবল স্বাধীনতার পথ দেখিয়ে ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। যে মহান নেতা গোলামির জিঞ্জির থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন, জীবনের যৌবন যিনি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, সে মহান নেতার বুকে গুলি চালিয়ে নরদানবের দল সেদিন শুধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেনি। তারা সেদিন হত্যা করেছে একটি স্বাধীনদেশের স্থপতিকে। হত্যা করেছে বাঙ্গালি জাতিসত্তার জনককে। তারা হত্যা করেছে সৃষ্টিশীল স্বাধীন বাংলার উন্নয়নের সম্ভাবনাকে। সেই নারকীয় হত্যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে রন্ধ্রেরন্ধ্রে।
রাজনীতির পরিবর্তে অপরাজনীতির জন্ম হয়েছে। হতভাগ্য বাঙ্গালির জাতীয় জীবনে নেমে এসেছে তম্রাচ্ছন্ন অমাবস্যা। যে জাতি তার জন্মদাতা, মুক্তির কান্ডারি, পথের দিশারীকে হত্যার উৎসবে মেতে উঠতে পারে সে জাতির অপরাজনীতি ছাড়া আর কি ই বা শেখার আছে। তাইতো ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জীবন্ত হয়ে আছে অপরাজনীতির কালো অধ্যায়। গুম-খুন, দুর্নীতি আর প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ঘৃণ্য ও বিকৃতরুচির অরাজনৈতিক মহোৎসবের অনুশীলন হয়ে আসছে বহমান ধারায়। অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য। এছাড়া আর কি ই বা করার আছে। কারণ, আমরা তো জাতি হিসেবে নির্বোধ, অকৃতজ্ঞ। তা না হলে জাতির জনককে কেন হত্যা করা হলো? শুধু হত্যা করে ক্ষান্ত ছিলো কি? এদেশের স্বার্থান্বেষী অপরাজনীতি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্যকে ব্যাহত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলো। শেখ মুজিবের খুনিদেরকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পুনর্বাসন করেছিল। তাই পরিতাপ করে বলতে হয়, যে জাতি তার মুক্তির কান্ডারিকে মূল্যায়ন করতে পারে না, রক্ষা করতে পারে না সে জাতির সকল অর্জন মøান হয়ে যায়। বাঙ্গালির জীবনে বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব হঠাৎ করে হয় নি। অনেক চড়াইউৎরাই ফেরিয়ে জেল-জুলুম ভোগ করে তিনি নেতৃত্বের আসন অলঙ্কৃত করেছেন। বাঙ্গালির আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তিনি ডাক দিয়েছেন শোষণ মুক্তির আন্দোলনের। পরাধীন বাঙ্গালি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তা লুপে নিলো। তারও রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
তার এই ক্যারিস্মেটিক আহ্বানেই স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিপীড়িত কোটি বাঙালি। সেদিনের সেই বীরোচিত ঘোষণায় বাঙালি হয়ে উঠেছিল লড়াকু এক বীরের জাতি।আবার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাকে বন্দি থাকতে হয় পাকিস্থানের কারাগারে। তার আহ্বানেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। বন্দিদশায় মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়েও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ করেননি অকুতোভয় এ মহান নেতা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্থান। বীরের বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার পাশাপাশি দেশের মানুষকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। হিংসা-প্রতিহিংসা ভুলে গিয়ে, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের বিভাজন না রেখে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি।
দেশগড়ার এই সংগ্রামে চলার পথে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তার দেশের মানুষ কখনও তার ত্যাগ ও অবদানকে ভুলে যাবে না। অকৃতজ্ঞ হবে না। নবগঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু তাই সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের সাধারণ বাড়িটিতেই বাস করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। থেমে থাকেনি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু’র’ হৃদয়ে অকুতোভয় দেশপ্রেম দেখে এদেশের চিরশত্রæরা তাকে ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয়নি। কারণ, তিনি দেশকে, দেশের অর্থনীতিকে, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বহুদূর। বিশ্বদরবারে বাঙ্গালি জাতিকে সমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করবেন। তারা এটা হতে দেবে না কখনো। এই নীলনকশা বাস্তবায়নে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিলো তারা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপথগামী উচ্চাবিলাসী কয়েকজন সদস্যকে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যবহার করেছে। এই সুযোগ গ্রহণ করেছে মীরজাফরেরা।এরাই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে হামলা চালায় গভীর রাতে। হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সতেরো জন সদস্যকে । বিশ্ব ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সেদিন তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তার সঙ্গে বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলতে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাথার ইতিহাসও। বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম হত্যাকান্ড বাঙালি জাতির জন্য করুণ বিয়োগগাথা হলেও ভয়ঙ্কর ওই হত্যাকান্ডে খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত না করে বরং দীর্ঘ সময় ধরে তাদের আড়াল করার অপচেষ্টা করেছে পরবর্তী ক্ষমতাসীন চক্র। এমনকি খুনিরা পুরস্কৃতও হয়েছে নানাভাবে। হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেছিল বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোশতাক সরকার। বাঙ্গালি জাতির জনক এই মহান নেতাকে চরমশত্রæ পাকিস্থানিরা বুঝতে পেরেছিলো। বুঝতে পেরেছিলো তিনি নিছক কোন ব্যক্তি নন, তিনি স্বাধীনতাকামী মহান নেতা বাঙ্গালি সিংহপুরুষ। তার তুলনা তিনি নিজেই। তাকে হত্যা করা যায় না। তাই তারা মহান নেতাকে হত্যার দুঃসাহস করতে পারেনি। কিন্তু এই বাংলার কতিপয় নরপিশাচ এই মহান নেতাকে বুঝতে পারেনি। যে দুঃসাহস পাকিস্থান করতে পারেনি, তার চেয়ে হাজার কোটিগুণ নিকৃষ্ট পৈশাচিকতার পরিচয় দিয়েছে বঙ্গবন্ধু’র খুনিরা।
বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করলে তার মৃত্যু হয়নি। তিনি মরেও অমর হয়ে আছেন। কেননা তিনি একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে, ততোদিন তিনি বেঁচে থাকবেন। সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদেও প্রেরণায় প্রস্তুত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বলছিলাম, বিষাক্ত অপরাজনীতির নির্মম ছোবলের কথা।আজ বঙ্গবন্ধু হত্যার সাতচল্লিশ
বছরে উপনীত বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বয়স পেরিয়ে গেল। সংঘাত, সংকট, ষড়যন্ত্র আর জাতীয় রাজনীতিতে হিংসা-প্রতিহিংসার চর্চা দেখতে দেখতে জাতির যৌবন থেকে অর্ধশতাব্দী সময় চলে গেলো। এতো দিনেও কি আমরা কি জাতিকে অপরাজনীতির ছোবল থেকে মুক্তি দিতে পেরেছি? না, পারিনি। কেমন করে পারবো। পারার কথা ও নয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া, ক্ষমতায় টিকে থাকতে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরাই যখন রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হয়ে যায় তখন সে দেশে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের এদেশ সেই নোংরা সংস্কৃতির চর্চাক্ষেত্র।
তারই ধারবাহিকতায় শোকের মাস আগস্টে ঘটেগিয়েছিল আর একটি রোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ। সময়টা ছিল ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট।এই দিন ঢাকায় আওয়ামীলীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। এই হামলায় ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয় এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হয়। এই হামলায় নিহতদের মধ্যে আওয়ামীলীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী মিসেস আইভি রহমান অন্যতম, যিনি বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী। যদিও বর্তমানে এই ঘটনার বিচারিক কার্যক্রম চলমান। জাতি প্রত্যাশা করে এর একটা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু বিচার হবে। হওয়াই উচিৎ। প্রশ্ন হচ্ছে এমনটা কেন হবে? কেন শাসক গোষ্ঠী দেশের জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে। অপরাপর রাজনৈতিক দলের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবে। যখন যে রাজনৈতিকদল ক্ষামতায় থাকবে, সে দল দেশের সমগ্র জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এটাই তো সরকারের দায়িত্ব। তা না করতে পারলে স্বেচ্ছায় অক্ষমতা প্রকাশ পূর্বক ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো উচিৎ। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের সভ্যতা ১৯৭৫ সালের পনেই আগস্ট ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সেই থেকে উদ্ভট উটের পীঠে চলছে আমাদের দেশ, দেশের রাজনীতি। কোন দল ক্ষমতায় থাকাকালীন যদি কোন রাজনৈতিক সভাসমাবেশ থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করতে ব্যর্থ হয় তার দায়ভার ঐদলের উপর বার্তায় এটাই স্বাভাবিক। তখন শাসক হিসেবে ন্যায় বিচার নিশ্চত করা নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়ে। আমরা তার উল্টোটাই দেখি আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে। আমরা জাতীয় সংসদে এমন নির্মম পৈশাচিকতা নিয়ে হাস্যপরিহাস করতে দেখি। ঘটনার তদন্ত ছাড়াই আমরা মন্তব্য করতে সিদ্ধহস্ত।
দোষারোপের রাজনীতিতে আমাদের নেতৃবৃন্দ বড়-পটু। কোন ঘটনার দায় স্বীকার না করতে যতো প্রকার অপকৌশল আছে তাতে আপত্তি থাকে না কারো। জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয় গুলোকে টল করতে করতে পানসে করে তুলি। রাজনীতিতে নীতির বড়ই সংকট। কিন্তু শেখার বিষয় হলো, ইতিহাস কখনো কাউকে ক্ষমা করে না। ইতিহাস তার আপন শক্তির উপর ভর করে চলে। সময় পেলে ইতিহাস কথা কয়। ক্ষমতার রাজনীতি চিরস্থায়ী নয়। এই সত্য রাজনীতিবিদদের সহজে অনুধাবন করা উচিৎ। তাহলেই কেবল দেশ অপরাজনীতির ছোবল থেকে রক্ষা পেতে পারে, অন্যথায় নয়।
লেখক : প্রভাষক, কবি ও প্রাবন্ধিক।