দৈনিক ফেনীর সময়

‘স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু’

‘স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু’

নাসির উদ্দিন বাহার

বেদনাবিধুর ১৫ই আগষ্ট আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসছে । ১৯৭৫ সালের এই দিনে রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে, দুই কন্যা ব্যতিত, সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলো খোন্দকার মোশতাক এবং সেনাবাহিনী দলছুট একদল ঘাতক সেনা অফিসার। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাঙালির অভিসংবাদিত নেতা স্বধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা নিহত হলেন স্ব চক্রান্তকারীদের দারা। পৈশাচিক এই খুনী চক্র এমনই নিষ্ঠুর ছিল যে, তাদের হাত থেকে ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল ও রক্ষা পায়নি।

এ-তো শুধু ব্যক্তি শেখ মুজিবের শারীরিক হত্যাকান্ড নয় এর নেপথ্যে ছিল সু-গভীর চক্রান্ত। তারা হত্যা করতে চেয়েছে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারাজীবনের আন্দোলন সংগ্রামের শ্রেষ্ঠতম অর্জন। জাতির পিতার হত্যার মধ্য দিয়ে ৭১ এর পরাজিত শত্র“রা ও বিষাক্ত সাপের মতো ফনাতুলে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তাদের কুট-ষড়যন্ত্র-আর হামলার শিকার হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ ও চেতনা।

বাংলার সুদীর্ঘ ইতিহাস বহু বরেণ্য মনিষীর দীপ্ত পদচারণায় মুখর। মাত্র ৫৫ বছরের অতি সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যে অসাধ্য সাধন করেছেন যে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। সে জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে কারাগারে। শৈশবে একের পর এক রুস্নতা পর্বতের মতো পথরোধ করে দাড়িয়েছে তাঁর। কিন্তু তৎকালীন ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়ার এই দামাল ছেলেটিকে পরাস্ত করতে পারেনি। যেখানে অন্যায় দেখেছেন প্রতিবাদ গর্জে উঠেছেন দিদ্বাহীন ভাবে পাশে দাড়িয়েছেন নিপিড়ীত মানুষের, ছুটে গেছেন দেশের এই প্রান্ত থেকে সেই প্রান্তে। ধর্ম কর্ম নির্বিশেষে দুর্গত নিপীড়িত মানুষের প্রতি তার সহজাত ভালবাসার টানে তিনি রাজনীতি করেছেন বাংলার কাদা জলে বেড়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু-সাধারণ মানুষের একজন হিসেবে ট্রেনে-লঞ্চে- নৌকায় ছড়েছেন কর্দমাক্ত পথ হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। সে কারণে প্রিয় স্বদেশবাসীর হাড়ি ও নাড়ির খবর ছিল তার নখদর্পনে- তার উচ্চতা বাঙালীর গড়পড়তা উচ্চতাকে ছাড়িয়ে গেলেও তিনি ছিলেন আপাদ মস্তক বাঙালী। তার মাথা আকাশ স্পর্শ করলেও পা ছিল মাটিতে, শেকড় ছিল জনগণের হৃদয়ের তলদেশ অবধি বিস্তৃত। একের পর এক অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে তাকে জয় করতে হয়েছে হতাশায় নুয়ে পড়া দারিদ্র্য, ক্লিষ্ট ও বহুধা বিভক্ত একটি জনগোষ্ঠীর মত। ধাপে ধাপে অভিজ্ঞতার সাহস ও প্রজ্ঞার সঙ্গেই নানা সংকট মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন মুক্তিযুদ্ধের অনন্য প্রেরণা দাতা। ১৯৪৮ এবং ৫২ সাল থেকে ধর্ম ভিত্তিক সা¤প্রদায়িক চেতনার বিপরীত দেশীয় সংস্কৃতি ভিত্তিক ধর্ম নিরপেক্ষ এক জাতীয় চেতনায় বিকাশ ঘটাতে সচেষ্ট ছিলেন বঙ্গবন্ধু-

বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুর ধারাবাহিক ঐতিহাসিক সংগ্রাম ছিল সু-চিন্তিত ও সুপরিকল্পিত। এ ব্যাপারে ৬০ এর দশকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস গঠন, পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা সহ উপযোগী স্লোগান প্রচার বিশেষ করে ‘জয় বাংলার’ মতো লক্ষ্যভেদী সশস্ত্র মারণাস্ত্রে সজ্জিত হানাদার পাকিস্তানীদের বুকে কাপন ধরিয়ে দেয়।

কোনো ভৌগলিক অঞ্চলের মানুষ শতসহস্র বছরের নানা উপাদান নানা ক্ষেত্রে প্রতিভাবান তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ধীরে ধীরে একটি জাতি বিকশিত হয়ে উঠে বাঙালী জাতির জীবনে সেই মাহেন্দ্রক্ষনে সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। আর সেই চূড়ার উপর দাঁড়িয়ে বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমেই ‘ভায়েরা আমার’ বলে যে সম্বোধন করলেন, যেন হাজার বছরের বাঙালীর যে ভালবাসার তৃষ্ণা এবং যে প্রত্যয় নির্ভরতা যার স্বপ্ন দেখেছেন সে নেতা এসে আমাদের সামনে দাড়িয়েছেন- ১০ লাখ লোক এক সঙ্গে লাফিয়ে উঠেছিল-সব মানুষ যেন আনন্দের উত্তেজনায় একাকার নেতার উপস্থিতিতে নিজেদের শক্তির প্রদর্শন করছিল তারা, ভাষনের শেষ অংশে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। বাঙালি হাজার বছর ধরে এই ঘোষনার অপেক্ষায় ছিল- এটি একটি অবিস্মরণীয় ভাষণ- এ ভাষনের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেন বাংলাদেশের ভাগ্য বিধাতা- রাজনীতির কবি। এই জন্যেই শেখ মুজিব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী।

তিনি বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্নের এবং অন্তরের অন্তস্তলে গুমড়ে মরা স্বাধীনতার আকাঙ্খার প্রকাশ ঘটিয়ে ছিলেন সেদিন। যুগের দাবীকে সাহস ও শৌর্যের ভাষা দিয়েছিলেন তিনি, দখলদার বাহিনীর কামান-বন্ধুক ও হেলিকপ্টার গানশিপের যে কোন মুহুর্তে গর্জে উঠার ভয়াল পরিস্থিতির মুখে।

পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন নেতা এমন ভয়ংকর জটিল পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে এমন অকুতোভয় স্বাধীনতার কথা উচ্চারণে সাহস করেননি-এই নজিরবিহীন ঘটনার জন্যই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা। নিজস্ব রাষ্ট্রসত্তাগত বাঙালী জাতির পিতা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা। তার চেয়ে প্রতিভাবন ও বহু গুণে গুনান্বিত বাঙালী অনেকেই ছিলেন- তবুযে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী-আধুনিক রাষ্ট্র সত্তার অধিকারী বাঙালী জাতির জনক।

তিনি হাজার বছরের বাঙালীর স্বাধীনতার স্বপ্নকে জীবনব্যাপী একনিষ্ঠ সংগ্রাম-ত্যাগ তীতিক্ষা কারাযন্ত্রনা ভোগ করে বাস্তবজীবন দিয়ে গেছেন-বাঙালীর অভ্যুত্থান দীর্ঘ সংগ্রাম আন্দোলন এবং বাঙালী জাতি নির্মাণের কারিগর এর মহাকাব্যিক অমর গাথার গৌরবজ্জল ইতিহাসের ধারাকে   দিয়ে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করার মতো ঘৃন্য কাজ-ঘাতকেরা তৎপর হয়েছিল। কিন্তু ঘাতকেরা ভাবতে পারেনি বঙ্গবন্ধু শুধু একজন ব্যক্তি নন-একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন বাঙালী জাতিকে ঐক্য সুত্রে আবদ্ধ করে।

স্বাধীনতার স্পপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে নিজেকে চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করে বলেছেন ‘একজন মানুষ হিসেবে-সমগ্র মানবজাতিকে নিয়ে আমি ভাবি। একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীদের সাথে সম্পর্কিত তই আমাকে গভীর ভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃত্তির উৎস ভালোবাসা, অখ্যয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

ভালোবাসায় মানুষ অন্ধ হয়। এই অন্ধকার ধরে ঘাতকেরা ৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট তাকে ছোবল মেরেছিল। এই হিংস্র হায়নারা এখনও বসে নেই- তারা এখনও না অযৌক্তিক বিতর্ক ধরে নানা প্রপাগান্ডা ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর বিশালতার কলঙ্কের কালি ছড়াতে চায়- কিন্তু ফিদেল কাস্ট্রোর হিমালয়কে সরিয়ে ফেলা কি সম্ভব? হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী ও আপাদমস্তক সাদা মানুষকে নিয়ে মূর্খ্যত্বের প্রলাপ বকে তার নামের স্বর্ণাক্ষর মুছেফেলা কি সম্ভব? জাতীয় শোক দিবসে একটি বিতর্কিত জন্মদিনের উৎসব করে ঘাতকের মুখে কাষ্ট হাসির আয়োজন কি শোভন?

জয় বাংলা

লেখক : সিনিয়র সহ-সভাপতি

সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!