দৈনিক ফেনীর সময়

ক্ষমা করবেন ভাইছা

ক্ষমা করবেন ভাইছা

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা হোসেন

বন্ধু আজ তোমার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। এই দিনে তোমাকে নিয়ে কোনো লেখার ইচ্ছা ছিল না কারন খাজা আহমদ এর মৃত্যুর পর আমি সকলের প্রিয় কর্মী হইতে পারি নাই। আমাকে যারা পছন্দ করে না তারা আমাকে খুব একটা শান্তিতে দলের কাজ করতে দেয় নাই আমি ধৈর্য ধরে দলের সাথে আছি। আমি কোন দিন দলের কারো সাথে বিরোধ করি নাই অনেকেই আমাকে বিরক্ত করেছে। কিন্তু আমি রাগ করে সভা মিছিলে না যাই গেলেও উপযুক্ত স্থানে মর্যাদা পাই নাই। আমরা ৭ই জুনের সভায় গেলাম যারা ৭ই জুন দেখে নাই তারাই বক্তৃতা দিতেছেন আমরা যারা ৬ দফা আন্দোলন করেছি সেই সভাতেও আমাদের স্থান নাই। দোস্ত টেক্সটাইল গেইটে ৬ দফার আন্দোলনে জননেতা জয়নাল হাজারী ও লুৎফুর রহমান গ্রেফতার হলেন। আমি পুলিশের লাঠিপিঠা খেয়ে দক্ষিণ দিকে ধানক্ষেত দিয়ে পালিয়ে বাঁচলাম। পরে ট্রাংক রোডে এসে ছাত্রজনতাকে নিয়ে মিছিল করে রাত ১১ টায় জয়নাল হাজারী ও লুৎফুর রহমানকে থানা হইতে মুক্ত করলাম।

জয়নাল হাজারীর সাথে তার ও আমার ছাত্র রাজনীতির প্রথম থেকেই একসাথে চলা হাজারীর বাড়ির কাচারী ঘরটি ছিল কমরেড হাউজ। সেই হাউজে দীর্ঘদিন একসাথে ছিলাম। পায়ে হেটে বিভিন্ন থানাতে স্কুলে ছাত্রলীগ গঠন করি। এভাবে আমৃত্যু সকল আন্দোলন নির্বাচন জয়নাল হাজারীর সাথে ছিলাম। ১৯৮৬ সালে প্রথম এম.পি নির্বাচনে জয়নাল হাজারী দেওয়া একটি সবুজ চাদর এখনো আমার কাছে রক্ষিত আছে। যে স্মৃতি আমি এখনো বহন করি। যারা জয়নাল হাজারীকে গভীরভাবে জানে তার রাজনীতি ও নেতৃত্বের জন্যে কত আন্তরিক ছিলাম তবে আমি কখনো তার অন্ধ ভক্ত ছিলাম না। বিভিন্ন কারনে হাজারী সাহেব যতদিন ফেনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন আমি কোন জেলার কোন পদে ছিলাম না।

১৯৯০ সালের এম.পি নির্বাচনে আমিও দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলাম হাজারী সাহেব মনোনয়ন পায় তার জয়ের জন্য যতটুকু আমার সামর্থ্যে ছিল রাত দিন তার বাসায় ও খাজা আহমদের তৃপ্তি বোর্ডিং থেকে নির্বাচনের কর্মকান্ডে জড়িত ছিলাম। তিনি ফেনী মহকুমা ও নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ফেনী কলেজ ছাত্র সংসদের জি.এস ছিলেন। আমি কোনদিন বড় নেতা হইতে চাই নাই ফেনীর সেন্ট্রাল হাই স্কুলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক (সভাপতি এ্যাডভোকেট ছিলেন হাফেজ আহমেদ)। ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক, মহকুমা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক ১৯৬৪ সালের কপের দপ্তর সম্পাদক (খাজা আহমেদ কপের সভাপতি), ফেনী মহকুমা শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারাণ সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধ কালীন মহুরী ইয়থ ট্রেনিং ক্যাম্পের ডেপুটি ক্যাম্প চীফ (খাজা আহমদ ক্যাম্প চীফ), যত পদ পদবী ও রাজনৈতিক সম্মান যত পেয়েছি সব খাজা আহমদ সাহেবের আমলেই পেয়েছি। অন্যেরা আমাকে ব্যবহারই করেছেন।

সর্বশেষ নিজাম উদ্দিন হাজারী এম.পি ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক করেছেন। একমাত্র খাজা আহমদ আমার রাজনৈতিক জীবনের স্বীকিৃতি দিয়েছেন প্রিয় নেতা খাজা আহমদ সাহেবকে শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করছি। আমৃত্যু খাজা সাহেবের সাথে ছিলাম বর্তমানে খাজা আহমদ পরিষদের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন (সাপ্তাহিক জাতীয় বার্তা সম্পাদক) একেএম শামসুল হক তাকেও স্মরন করছি। আমরা দুই জনেই খাজা আহমদের অনুসারি হিসেবে পরিচিত। সংবাদিক হিসেবে খাজা আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক আমার দেশ প্রত্রিকা, দৈনিক ইত্তেফাকের ফেনী মহকুমা প্রতিনিধি ছিলাম। আমাদেরকে বাদ দিয়ে ফেনীর কোন সঠিক ইতিহাসই লেখা যাবে না। আজকের লেখা নিয়ে লিখছিলাম যে, হাজারী ভাইকে নিয়ে কিছু লিখব না কারন যাহা কিছু করি বা বলি গুটি কয়েকজন আমার লেখা ও বলা কে রংধনু মিশিয়ে অসত্য কথা বলা ও কান ভারী করেন। যেমন হাজারী ভাইয়ের মৃত্যুর দিনে কবর দেওয়ার পর নোয়াখালী জেলার কয়েকজন নেতা হাজারী ভাইকে মাটি দেওয়ার জন্য আসলেন কবর দেওয়ার শেষ নাগাদ পর্যন্ত আমি সহ নিজাম হাজারী মুজিব উদ্যানে ছিলাম। নোয়াখালীর নেতারাও আমাদের সাথে পরিচিত হইতে আসলেন। তারপর নিজাম হাজারী তাদেরকে বাসায় চা খাওয়ার জন্যে নিয়ে গেলেন। আমিও সাথে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ হাজারী সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের অনেক স্মৃতি আলাপ হইলো। এর ই মধ্যে আমি হাজারী সাহেবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে আলাপ করলাম।

আমি বললাম জয়নাল হাজারী কোন এক সময় আমাকে বললেন মানুষ তো মারা যাবে আমরা সবাই মারা যাব। তবে আমি মারা যাবার পর নিজাম হাজারী যদি জীবিত থাকে তাহলে তোমাদেরকে আমার লাশও ছুইতে দিবে না। যাবতীয় কর্ম নিজাম হাজারী ই করবেন বিষয়টি অত্যন্ত সত্যে প্রমানিত হইল এই কথাটি বললাম। কে বা কাহারা ঐ আলাপচারিতা ভিডিও করলেন এবং মোবাইলে ভাইরাল করলেন হাজারী সাহেবের অতি উৎসাহি ভক্তরা আমাকে নিজাম হাজারীর চামাচা ইত্যাদি ফেসবুকে মন্তব্য করলেন। আমি আগেই বলেছি আমি বাস্তব বাদি এবং বাস্তবতাই বিশ্বাস করি। হাজারী সাহেব ফেনী ত্যাগ করার পর যেভাবেই হোক নিজাম হাজারী একক নেতৃত্বে আছেন এই বস্তবতা যারা অস্বীকার করে তাদের নিকট আমার দু:খ প্রকাশ করা ছাড়া আমার কিছু বলার নাই। ফেনীর ইতিহাসে ১৯৭৬ সালের ২৯শে মে রাত ১০.৩০মিনিটে ফেনীর মিজান ময়দানে তখন কার সময় ফেনীর ইতিহাসে খাজা আহমদের বৃহত্তম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

ফেনীর সকল জানাজাকে রেকর্ড ভেঙ্গে জয়নাল হাজারীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। কবে আবার এই রেকর্ড ভাঙ্গা হয় তার কোন ঠিক নেই। উক্ত জানাজায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে লোক অংশগ্রহণ করেন যেমন চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ঢাকা, কুমিল্লা হইতে অনেকেই আসে। যারা রাজনৈতিক জীবনে জয়নাল হাজারীর কর্মে সন্তুষ্ট নয় তারাও এক বাক্যে স্বীকার করবেন ফেনীর ইতিহাসে একটি সর্ববৃহৎ জানাযা। যেমন হাই স্কুল মাঠ জায়গা সংকুলান না হওয়ায় জানাজা ও লোকসমাগম গুদাম কোয়ার্টার ফেনীর পৌরসভা, মাষ্টার পাড়া, কলেজ রোড, হইয়া ট্রাংক রোড, রাজাঝির দিঘীর পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ-উত্তর পাড়ায় তিল ধারনের স্থান ছিল না। ফেনী গার্লস স্কুল এবং ফেনী বড় মসজিদ/জামে মসজিদ পর্যন্ত লোক সমাগম ছিল জীবনের শেষ সময় প্রাপ্য সম্মান না পাইলেও শেষ বিদায় বেলায় ফেনীবাসী ও রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের অতল শ্রদ্ধা নিয়ে জয়নাল হাজারী মুজিব উদ্যানে শুয়ে আছেন। নিজাম হাজারী আন্তরিক ছিলেন বলে রেকর্ড ভাঙ্গা জানাজা হয়েছে শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা সঠিক নয়। বাস্তবতাকে মানতে হবে রাজনৈতিক কর্মীরা ফেনী আসলেই অনেকেই এখনো জয়নাল হাজারীর কবর জিয়ারাত করে থাকেন। জয়নাল হাজারী দেশে বিদেশে এত পরিচিত ছিলেন যে যদি কেহ ফেনীবাসী হিসেবে পরিচয় দেয় তখনি অপর পক্ষ থেকে প্রশ্ন আসে আপনি কি ভাইছা ফেনীর জয়নাল হাজারীকে চিনেন? যে যাই বলুক আরেক জন জয়নাল হাজারী কবে জন্মগ্রহণ করবে জানিনা। আজ ফেনীতে আওয়ামীলীগ এত বেশী শক্তিশালী খাজা আহমেদ, জয়নাল হাজারী, নিজাম হাজারীর কারনে আমি প্রায় সময় বলি সাদা চুলের নেতা কর্মীরা হলেন খাজা আহমদের সৃষ্টি আর মাতার চুলে সাদা ও কালো চুলের নেতাকর্মী সৃষ্টির নায়ক জয়নাল হাজারী। বর্তমানে কালো চুলের কর্মীরা নিজাম উদ্দিন হাজারীর সৃষ্টি।

জয়নাল হাজারী কোন ভুল যে করেন নাই তা নয়। তিনি যদি ভুল না করে থাকেন তাহলে কেন তিনি দীর্ঘদিন ফেনী থাকতে পারেন নাই। কেন তিনি রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে পারেন নাই। কেউ কেউ বলেন জয়নাল হাজারীকে ফেনীতে থাকতে দেওয়া হয় নাই। সেই সুযোগ কেন দিয়াছেন। আমার দৃষ্টিতে হাজারী সাহেবের কাল হয়েছে ভারতে আশ্রয় থাকা কালীন অনলাইন পত্রিকা তিনি বেশ কিছু লোককে বিভিন্ন মন্তব্য করে ক্ষেপিয়ে তোলেন। যারা পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে হাজারীর বিরোধী হন এবং এখানে কৌশলের কাছে হাজারী স্বঅবস্থান পুনরুদ্ধার করতে পারেন নাই। ষড়যন্ত্রের হাজারী বির্তকিত হন। হাজারী বিরোধীরা ঢাকা ও ফেনীতে যেই কৌশল অবলম্বন করা দরকার তাই করেছেন। তবে যারাই এই কৌশল অবলম্বন করুক না কেন হাজরীর প্রতি ন্যায় বিচার করেন নাই।

হাজারী সাহেব ফেনী ত্যাগ করার পরেও ভাবতেন তিনি পূর্বের অবস্থানে আছেন আসলে বস্তবতা ভিন্ন। আমরা আজ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যাই বলি বা লিখি না কেন জয়নাল হাজারীর সাথে কারো তুলনা হয় না। আজ আমরা যারা ফেনীতে আওয়ামী লীগের সুফল ভোগ করছি এর জন্য জয়নাল হাজারী বহুবার জীবনের ঝুকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠককে শক্তিশালী করেছেন। আজ আমাদের বর্তমান নেতা নিজাম হাজারীও জয়নাল হাজারীর অনেক কর্ম অব্যাহত রেখে দলকে ওয়ার্ড পর্যায়ে সংগঠিত রেখেছেন। যাহা নিজাম হাজারী ইচ্ছা করলে ফেনী ট্রাংক রোডে ২/৩ ঘন্টার নোটিশে ৪০/৫০ হাজার লোক সমাগম করতে পারেন।

জয়নাল হাজারী একজন আলোচিত নেতা তার সম্বন্ধে সকল কর্ম লেখা ও বলা অনেক কঠিন পরিশেষে একটি পুরানো উদাহরণ দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব। এক দেশে এক রাজা তার মন্ত্রী সভার কয়েকজন সদস্যকে বললেন যে শুনলাম কুকুরের ঘরে আমার কয়েকটি কুকুর ছানা জন্ম নিয়েছে রাজা একজনকে পাঠালেন। দেখে আসার জন্যে দেখে এসে বললেন ৭টি কুকুর ছানা জন্ম নিয়েছেন। অপরজনকে পাঠালেন তিনি এসে বললেন ৪টি গোলাপী রঙ্গের ৩টি কালো। শেষমেষ তিনি আরও একজন প্রবীণ মন্ত্রীকে পাঠালেন তিনি বললেন রাজা মশাই আপনার কুকুর ঘরে ৪টি গোলাপী রঙের ৩ কালো রঙের গোলাপী ৪টির মধ্যে ১টির একটি পা নাই, ২ টি অসুস্থ্য, একটি ভালো আছে, আর কালো ৩ টির মধ্যে একটি অসুস্থ্য একটি পিছনের একটি পা নাই, একটি ভালো।

আজকের লেখায় আমি পাঠকদের বলব আমি একজন প্রবীণ লোক যাহা বাস্তব যার যাহা প্রাপ্য তাই উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। পাঠক আমার শেষ মন্তব্য ফেনীর ভাইছা জয়নাল হাজারী আমাদেরকে ক্ষমা করবেন যে কোন কারনে হউক আপনাকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারে নাই। জানাজা যদি আপনার দেখার সুযোগ থাকত তাহলে আপনি নিজেও বিশ্বাস করতে পারতেন না। যে এত লোক আপনার জানাজায় এসেছে জীবন থাকতেও আপনি আলোচিত মৃত্যুর পরেও আপনি আলোচিত আমি মনে করি এটাই আপনার স্বার্থকতা। জয়নাল হাজারী ভাইছার প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক, জেলা আওয়ামী লীগ, ফেনী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!