দৈনিক ফেনীর সময়

ফেনীতে ভিক্ষুকের হার বাড়ছে

ফেনীতে ভিক্ষুকের হার বাড়ছে

বকুল আকতার দরিয়া :

রেমিটেন্স যোদ্ধাদের শহর ফেনীতে স্থানীয় ও বিভিন্ন জেলার নদীভাঙ্গন এলাকা থেকে আসা অসংখ্য নারী-পুরুষ ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিচ্ছে। ফলে দিনদিন এই শহরে ভিক্ষুকের হার বাড়ছেই। সরকারি-বেসরকারি নানা সাহায্য-সহযোগিতা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলেও অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিটাকেই আয়ের উৎস্য হিসেবে বেছে নিয়েছে।

অনেকে বলছেন, বিদেশ থেকে বেশি রেমিটেন্স আসে ফেনী জেলাতে। তাই হাত পাতলেই পুণ্যের আশায় ৫/১০ টাকা বাড়িয়ে দেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে, স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণ ঘটেছে। প্রয়োজনের তাগিদে ঘরের বাইরে গেলেই বাজারমুখী বা শহরমুখী হলেই দেখা যায় সাধারণ পথচারীর তুলনায় ভিক্ষুকের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।

দেখা গেছে, ২০২০-২১ সালের করোনা পরবর্তীকালীন সময়ে ফেনীতে ভিক্ষুকের সংখ্যা মারাত্মক হারে বেড়েছে। ফলে যেখানেই যাই সেখানেই ভিক্ষুক হাত পেতে সামনে এসে দাঁড়ায়। এতে সাধারণ নিম্নআয়ের মানুষরা বিব্রতবোধ করে। রাস্তায়, হোটেলের সামনে, দোকানের সামনে, হোটেলের ট্রাংক রোডের দোয়েল চত্বর, খেজুর চত্বর, হাসপাতাল মোড়, শহীদ মার্কেট ও গ্র্যান্ড হক টাওয়ার, বড় মসজিদ, জহিরিয়া মসজিদ. কোর্ট মসজিদ, রাজাঝির দিঘীর পাড়, বিজয় সিংহ দিঘীর পাড়, মহিপাল বাসস্ট্যান্ড, ফেনী রেলওয়ে স্টেশন সহ বিভিন্ন স্থানে পেশাদার ভিক্ষুকের উপদ্রব চরমে পৌঁছেছে। যদিও ভিক্ষাবৃত্তি কোন স্বীকৃত পেশা নয়; তবুও এটিকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে কিছু সুবিধালোভী মানুষ।

সরেজমিনে কয়েকজন ভিক্ষুকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা কেউ-ই ফেনীর বাসিন্দা নয়। ভোলা, রংপুর, নীলফামারী, শরীয়তপুর ও গাইবান্ধার নদী ভাঙ্গন দুর্গত এলাকা থেকে এসেছে। এদের মধ্যে এতিম, অসহায়, বিধবা, রোগাক্রান্ত হতদরিদ্ররাই এ পেশায় আত্মনিয়োগ করেছে। তবে কাজে অক্ষম ভিক্ষুকের চেয়েও সক্ষম নারীদেরও ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেখা যায় বেশি।

জৈতন বেগম নামের একজন পঞ্চাশোর্ধ নারী জানান, তার বাড়ি শরীয়তপুর জেলার নাড়িয়া উপজেলায়। তিনি তিন সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে গত বছর ফেনী এসে খাজুরিয়া এলাকায় ১২শ টাকায় একটি কলোনীতে থাকেন। স্বামী রিকশা চালায়। তার বড় মেয়েও ভিক্ষা করে। ভিক্ষা করে তিনি দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পান।

শহীদ মার্কেটের সামনে কথা হয় সুকজান বেগম নামের একজন নারী ভিক্ষুকের সাথে। ভিক্ষা করেন কেন, কাজ করতে পারেন না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাসায় কাজ করে যা পাই তাতে সংসার চলে না তাই ভিক্ষা করি।

খেজুর চত্ত¡র সংলগ্ন সড়কে ভিক্ষা করা মতিন বলেন, সংসারে ৫ জন পেট চালাতে তাকে ভিক্ষা করতে হয়। ২০১৮ সালে নদী আমার বাড়ি-ঘর ভেঙে নিয়ে গেছে সেই থেকে আমি পরিবার নিয়ে ফেনীতে আছি এবং ভিক্ষা করে খাই। সরকার সাহায্য সহযোগীতা করলে ভিক্ষা করতে হতো না।

ষাটোর্ধ্বো ফজল মিয়া বলেন, তার বাড়ি ভোলা জেলায়, নদী তার বসত ভিটা জমি-জিরাত এবং দুই মেয়েকে নিয়ে গেছে, তিনি এখন যেখানে রাত সেখানে কাত।

হাতে দু’আঙ্গুলবিশিষ্ট সিদ্দিক মিয়াকে পাওয়া গেল শহীদ মার্কেটের সামনে, হাতে বিড়ি, মুখে পান চিবাচ্ছেছন তিনি, বললাম, ভিক্ষে করে পান-বিড়ি খান, বিবেকে বাঁধে না? তিনি বললেন, অনেক পুরানা অভ্যাস মা, ছারতাম হারিনা (ছাড়তে পারিনা)। আমার সাথে তাদের কথোপকথনে দেখা গেছে, বিভিন্ন জাতের ভিক্ষুকদের মধ্যে নারী-পুরুষ, শিশু, বোরকাপরা কিশোরী, মাঝবয়সী যুবক-বৃদ্ধা, সমর্থ-অসমর্থ প্রভৃতি সকল প্রকার লোকই এ পেশার অন্তর্ভুক্ত। এদের জন্য সরকারি বরাদ্দ থাকলেও এরা জানেই না যে, সরকারি কোন সহায়তা এদের জন্য আসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কলেজ শিক্ষক বলেন, ‘যেখানেই যাই সেখানেই ভিক্ষুক, বড় আমলাদের সবাইতো নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত, এদের নিয়ে কেই ভাবেনা। সাংবাদিকরাও কিছু দেখেনা।’

ট্রাংক রোডের খেজুর চত্ত¡রের ফল ব্যবসায়ী আব্দুল মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান, শিল্পপতিরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়, চোখে লাল চশমা দিয়ে হাঁটে, গাড়ি করে যাতায়াত করে, এদের দেখেনা, এদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে গেছি।’

ভিক্ষাবৃত্তির অভিশাপ থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে হলে একদিকে যেমন এর কারণ দূর করা দরকার, অন্যদিকে তেমনি সত্যিকারের ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারলে অনেকাংশে এ সমস্যার সমাধান হবে।

কাজ করতে পারেন এমন ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী নানা কাজে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। ‘ভিক্ষা দানে পুণ্য লাভ হবে’ এমন মনোভাব বাদ দিয়ে কেবল সত্যিকার ভিক্ষুককে সাহায্য করলেও পেশাদার ভিক্ষুকের উপদ্রব কমে যাবে। তবে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, দেশের দারিদ্র ঘোচানো এবং আর্থিক উন্নয়ন সাধন।

বাংলাদেশের দারিদ্র নিরসনে সরকারের অঙ্গিকার বাস্তবায়ন এবং ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদাকর পেশা থেকে মানুষকে নিবৃত করতে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনবার্সন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে “ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আগষ্ট/২০১০ খ্রীষ্টাব্দে হতে এ কর্মসূচির কার্যক্রম শুরু হলেও এর তেমন কোন ব্যাপকতা চোখে পড়েনা।

২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত সরকারের বরাদ্দ ও ব্যয়ের বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থ ৫শ টাকা এবং মোট ব্যয়ও ৫শ টাকার উপকার ভোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৮শ ৫০ জন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমান ২ হাজার ৬শ ৮০ টাকা। সম্ভাব্য উপকারভোগীর সংখ্যা ৩ হাজার জন। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ৪১টি জেলায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও অন্যান্য ব্যয় খাতে এ অর্থ প্রেরণ করা হয়েছে এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন জেলায় অর্থ প্রেরণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে।

ছাগলনাইয়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলমগীর মিয়া বলেন, আমাদের ১৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি আছে, এর সভাপতি হচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং আমি সদস্য সচিব। বরাদ্দ আসলে প্রথমে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এসে বিভিন্ন উপজেলায় পাঠানো হয়। এর বেশি আমি কিছু জানি না। তবে স্থানীয় এবং অন্য জেলা থেকে আসা ভিক্ষুকদের জন্য স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে তাদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে এ ভিক্ষাবৃত্তি থেকে সমাজ পরিত্রাণ পাবে।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ভিক্ষুকদের জন্য বরাদ্দ আসে এবং তা শুধু স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য। শুধু ১৫ জন তালিকাভ‚ক্ত স্থানীয় ভিক্ষুকদের মাঝে দেয়া হয় তবে তা ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেয়ার শর্তে। তিনি আরো বলেন, সরকারি উদ্যোগে অন্য জেলা থেকে আসা ভিক্ষুকদের নিজ জেলায় নিয়ে গিয়ে তাদের বসবাসের জন্য আবাসন নির্মাণ করে এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিলেই হয়তো ভিক্ষাবৃত্তির মতো মারাত্মক ব্যাধি থেকে দেশ ও সমাজ রেহাই পেতে পারে।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহামুদুল হাসান বলেন, প্রতি বছর নির্ধারিত বরাদ্দ থেকে স্থায়ী বাসিন্দা যারা ভিক্ষবৃত্তি করে তাদের তালিকা করে গরু-ছাগল দেয়া হয় তবে তা ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেওয়ার শর্তে। তিনি আরো বলেন, ভাসমান ভিক্ষুকদের জন্য পুর্নবাসন ও প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে ভিক্ষাবৃত্তি কমে যাবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!