দৈনিক ফেনীর সময়

মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার রূপরেখা

মসজিদ ভিত্তিক সমাজ  ব্যবস্থার রূপরেখা

নাজমুল হক:

বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ নিরাপদ একটি দেশ। আদমশুমারি তথ্যানুযায়ী প্রায় নব্বই শতাংশ মুসলিমের বসবাস। এই বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী ইসলামের ধর্মীয় ইবাদত-বন্দেগি করার লক্ষ্যে নিজস্ব উদ্যোগে প্রায় ৪.৫ লক্ষাধিক মসজিদ গড়ে তুলেছে। কোন কোন মসজিদ আধুনিক স্থাপত্যরীতি ও চোখধাঁধানো নান্দনিকতায় দেশের সেরা মসজিদ। রাজধানী ঢাকাতেই প্রতিটি মহল্লা অলিগলিতে অসংখ্য মসজিদ রয়েছে। মসজিদের আজানের সুরের মূর্ছনার কারণে বিশ্বের নিকট ঢাকার পরিচিতি মসজিদের শহর। শুক্রবার জুমার খুতবায় মসজিদগুলো কানায় কানায় ভরপুর হয়ে ওঠে। মসজিদের দান বাক্সটা টাকায় টাকায় ভরে যায়, মুসলমানদের টুপি নতুন নতুন বাহারী পোশাক তাকবির-তাসবিহে মনকাড়া দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। এই মসজিদগুলো সামাজিক নিরাপত্তা, উন্নয়ন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে।

একটি স্বাধীন মুসলিম দেশের মসজিদগুলোতে দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ছাড়া কোন সামাজিক প্রোগ্রাম, শিক্ষা প্রোগ্রাম, গ্রামের সালিশ কেন্দ্র, সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজ সেবার কেন্দ্রবিন্দু কিছুই নেই। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সঃ এর ইসলামের অনুশীলন অনেকাংশেই অনুপস্থিত। নামাজে মসজিদের খতিবকে যে অর্থে ইমাম বা নেতা বানিয়ে তার আনুগত্য করা হয়। ঠিক একই অর্থে সমাজ ব্যবস্থায় ইমামের নেই কোনো নেতৃত্ব। সমাজ পরিচালনা করে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এবং অধিকাংশ মসজিদের সভাপতি কালো টাকার মালিক এবং মহাজনি সুদখোর ও ঘুষখোর ইত্যাদি। ৯৫শতাংশ মসজিদ কমিটির নামাজের ইমামতি করা এবং জুমার খোতবা দেওয়ার যোগ্যতা নেই। সেজন্য মসজিদে সামাজিক উন্নয়নমুলক কার্যক্রম নেই। রাসুলুল্লাহ সাঃ ১৭ বছর বয়সে হিলফুল ফুজুল নামের সেবামূলক সংস্থা গড়ে তুলে গরীব অসহায় নিপিড়ীত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। দারিদ্র্য দূরীকরণ করেছিলেন। মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম এবং দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম গ্রহণ করে ছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আরবের মুসলমানরা ছিল সেবক এবং মসজিদগুলে সামাজিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু।

এখন বাংলাদেশের মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারির দ্বায়িত্ব হলো মসজিদকে শুধুমাত্র নামাজ পড়ার স্থান বানানো। সামাজিক নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কাজে মসজিদের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। মসজিদ ইমামের নেই কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা। সমাজব্যবস্থায় যেহেতু মসজিদের কোনো সামাজিক উন্নয়নমুলক প্রোগ্রাম নেই, তাই ইমাম মুয়াজ্জিন সাহেবদের নেই কোনো সামাজিক দ্বায় দায়িত্ব।

মুসলমানদের দেশে ইমামের নেতৃত্ব শুধু মসজিদের নামাজে এবং সামাজিক সালিস ও বিচারের নেতৃত্ব এলাকার সুদখোর ও ঘুষখোর লিডারদের হাতে, সেজন্য ইমাম সাহেব সমাজের ধার ধারে না, তেমনই সামাজের লিডারগন ইসলাম ধর্মের সাম্য মানবতা শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ধার ধারে না। ফলে মুসলমানদের সমাজে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর হিলফুজুলের কোন অনুশীলন নেই। খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনকাল ইসলামের সোনালি যুগে মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতো এবং সামাজিক সালিস ও ন্যায় বিচার ইত্যাদি সামাজিক সমস্যার সমাধা হতো। সামাজিক বিচার-আচার, বিবাহ-শাদি, দারিদ্র্য বিমোচন, যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি কার্যক্রম মসজিদকে ঘিরেই অনুষ্ঠিত হতো। রাষ্ট্রীয় ফরমান, সামাজিক ও প্রাকৃতিক দুযোগ মোকাবিলা ও সতর্কবার্তা, এমনকি কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণাও মসজিদের মিম্বার থেকে ঘোষিত হতো। কিন্তু যখন মসজিদের খতিব মাওলানা মুফতি থেকে সামাজসেবা ও বিচার কার্যক্রম সামাজিক লিডারদের হাতে চলে যায়, তখন থেকেই সামাজিক নেতৃত্ব ঘুষখোর দুনীতিবাজ ও সুদখোর কাবুলিওয়ালের হাতে বন্দী হয়ে গেল। মুসলমানদের ইসলামের ধর্মীয় বিধান আটকে থাকল মসজিদের ইবাদত বন্দেগীতে এবং ব্যক্তিগত সমাজ সেবামূলক কার্যক্রমে। সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা অর্থব্যবস্থা দখলে নিয়েছে সুদখোর ঘুষখোর দুনীতিবাজরা, মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা সাহেব হয়ে গেল মসজিদ কমিটির পেইড গোলাম। খতিব মাওলানা মুফতি আল্লামা সাহেব হয়ে গেল লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক দলের লিডারদের গিনিপিগ ইত্যাদি। মসজিদে ইসলামি বিধিবিধান পালন করা বন্ধ হয়ে যায়।

রাসুলুল্লাহ সাঃ এবং খোলাফায়ে রাশেদার যুগে শুধুমাত্র নামাজ পড়ানোই ইমাম সাহেবের কাজ ছিল না। আরব এবং পারশ্যের সামাজিক লিডারশীপ তাদের অধীনে ছিল, মহল্লার সামাজিক নেতৃত্ব ও দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক উন্নয়ন, শালিশ ও বিচার ব্যবস্থা তাদের অধিনে ছিল। ঈমামের কাজ শরিয়তের বিধান তারা মানুষকে জানাবেন, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করবেন। তাদের কথামতো সকল মুসল্লিরা সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করবেন। মসজিদের সভাপতি সেক্রেটারি সবাই ইমাম সাহেবের অধীনে ছিল। মসজিদে মুসল্লি বাড়ানো ইমাম সাহেবের দায়িত্ব, মহল্লার মুসলমানদের নিকট কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি ছড়িয়ে দেয়া ইমাম সাহেবের ডে টু ডে কাজ। আমরা আমাদের সমাজ ও মহল্লা নিয়ে চিন্তা করতে পারি। মহিলাদের মসজিদে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারি, শিশুদের জন্য কুরআন ও হাদিস অধ্যায়ন অনুশীলনের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। মসজিদে যাকাত ও সাদাকাহ ফান্ড গঠন করে সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে ভুমিকা রাখতে পারি। দুস্থ এতিম শিশু কিশোর কিশোরী উন্নয়ন প্রোগ্রাম গ্রহণ করা, গরীব অসহায়দের খাদ্য ও চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করা। গরীব নারী ও পুরুষের বিয়ে দিয়ে আয় রোজগারের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি সামাজিক প্রোগ্রাম গ্রহণ করা।

মসজিদকে কেন্দ্র করে যেকল সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। এক: মসজিদকে কেন্দ্র করে মহল্লাভিত্তিক সামাজিক উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ কমিটি গড়ে তোলা। এলাকার সকল মুসল্লিদেরকে সদস্য করা। মসজিদে নিয়মিত নামাজি লিডার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অপেক্ষাকৃত তরুণদেরকে কাজে যুক্ত করে, ইমাম, খতিব এবং শিক্ষিত জনশক্তি ও তরুণদের নেতৃত্ব দিতে হবে। মুসল্লিদের যাকাত, দান ও এককালীন অনুদানই এর একমাত্র আয়ের উৎস। এলাকার যেসব বিত্তবান মানুষ শহরে-বন্দরে ভালো চাকরি করে, বিদেশে থাকে তাদের কাছ থেকে কালেকশন করা। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। দুই. ঈদ, দুর্যোগকালীন ও শীতকালে মহল্লার ধনী মুসল্লিদের উৎসাহিত করে, বিধবা বৃদ্ধ ব্যক্তি ও দরিদ্র মুসুল্লিদের পাশে দাঁড়ানো। খাদ্য ও পোশাক বিতরণ করা। আয় রোজগারের জন্য আত্ব কর্মসংস্থানমুলক প্রোগ্রাম গ্রহণ করা। যাকাত ও সাদাকাহ ফান্ড এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ করা। তিন: মহল্লায় যারা কুরবানি দেয় তাদের থেকে গোশত সংগ্রহ করে, যারা, কুরবানী দিতে পারেনি, তাদের তালিকা তৈরি করে ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে তাদের বাসায় গোশত পৌঁছে দেওয়া। চার: সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সাদাকা তহবিল থেকে কুড়াল, কোদাল, দাঁড়িপাল্লা ইত্যাদি যন্ত্রপাতি ক্রয় করে রাখা। যার যখন প্রয়োজন হবে ইমাম সাহেবের কাছে নাম ও ফেরত দেওয়ার সময় লিখে নিয়ে যাবে। কাজ শেষে যথাযথভাবে পৌঁছে দেবে।

পাঁচ: কর্জে হাসানার প্রতি উৎসাহিত করে কর্জে হাসানাহ ফান্ড গঠন করা। আপদকালীন সময়ের জন্য উক্ত ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। অত্যন্ত শৃঙ্খলার সাথে সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। ছয়: প্রতিটি মসজিদে মক্তব চালু করতে হবে। যেখানে মক্তব চালু আছে সেখানে পাঠাগার শিক্ষা কেন্দ্র ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কুরআন ও হাদিস প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা। সাত: বিয়ে-শাদি মসজিদে করার জন্য উৎসাহিত করা। আট: সামাজিক বিচার-আচার মসজিদ-প্রাঙ্গণে করার ব্যবস্থা করা। নয়. মানুষকে মসজিদমুখী করার জন্য উৎসাহিত করা। নিয়মিত নামাজ পড়লে শিশুদের উৎসাহ দিতে পুরস্কার প্রদান করা। দশ: মসজিদের পাশে একটি দোকান থাকা উচিত। আতর, টুপি, জায়নামাজ, কাফনের কাপড় ইত্যাদি থাকবে। মসজিদের মুসল্লিদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয়ের ব্যবস্থা থাকা।

মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল সমাজ গঠন করা সম্ভব। দরকার সামাজিক উদ্যোগের। যাকাত ও সাদাকাহ ফান্ড গঠন করে সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রোগ্রাম গ্রহণ করে মসজিদকে সামাজিক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!