দৈনিক ফেনীর সময়

‘‘সবার উপরে মা’’ ‘‘হাঁটি হাঁটি পা পা তারপর আছে মা’’

‘‘সবার উপরে মা’’ ‘‘হাঁটি হাঁটি পা পা তারপর আছে মা’’

প্রফেসর ডি.এ. বিলকিস আরা চৌধুরী

‘মা’ একটি মাত্র শব্দ। কিন্তু ক্ষমতা যেন হাজার শব্দের চাইতে বেশী।মা শব্দটির মধ্যে কোন জাদু লুকিয়ে থাকে। মায়ের হাত ধরে প্রতিটি শিশুই পৃথিবীর আলো দেখে। এমনকি বাবার সাথে পরিচয়ও মায়ের মাধ্যমে হয়ে থাকে। জীবনের সকল দু:খ কষ্ট মোচনের সবচেয়ে বড় আশ্রয় হলো মায়ের আঁচল।

মা। এই একটি শব্দ গোটা জীবনের সমান। জীবনে মায়ের জায়গা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। কঠোর তস্ত চরানদর মধ্যে মা একফালি ছায়া। যেখানে চলার পথে বিশ্রাম নেয়া যায়। একমাত্র মাই সন্তানকে ভেতর থেকে বুঝতে পারে। আর সঠিক সমাধান মায়ের কাছেই থাকে।

মা একজন সন্তানের কাছে সব থেকে বড় শিক্ষক মা কোন বই বা শিক্ষক শেখাতে পারে না। জীবনেযা কিছু শেখা যায়, যা কিছু ভাবা যায়, সব কিছুর পেছনে মায়ের ভ‚মিকা আপরিসীম। বলা হয় ইশ্বরের দয়ার ইশ্বরই সব করেন, কিন্তু সন্তানের কাছে মাই ইশ্বরের মত। বিধাতার এক অপূর্ব আশীর্বাদ মা, তাই বলা হয় ‘‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’’ আবার বলা হয় ‘‘জননী স্বর্গ অপেক্ষা পরীয়দী।
মা মানে একটা রক্ত মাংসের অবয়ব যা, তার বদলে কিছু প্রশ্ন, কিছু উষত্ত সমস্যা, কিছু অসম্ভব কষ্টের সময়ে পাওয়া বা খানিকটা আরাম আর অনেকটা ভালোবাসা, সীমাহীন, অর্থহীন, স্বার্থহীন ভালোবাসা।

সন্তান যত বড়ই হয়ে থাক না কেন মায়ের কাছে সে একরকমই থাকে। মা হলো একটি ছেলের প্রথম প্রেমিকা আর একটি মেয়ের সারা জীবনের প্রিয় বন্ধু সন্তানের জীবনের সবচাইতে গোপন কষ্টের কথাগুলি কোন বন্ধুর সাথে নয়, কোন বোনের সাথে নয়, একমাত্র মায়ের সাথেই আলোচনা করা যায়। যে মাকি কখনই এই কথা প্রকাশ করবে না অথবা বিদ্রæপ করবে না।

পৃথিবীতে সবাই বদলে তেপে পারে কিন্তু মা বদলায় না। মা শিক্ষা দেয় অস্যার, ধৈর্যের, সাহ্যের, ত্যাগের এবং ক্ষমার, সব শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, ধনী কিংবা গরিব, বিবেচক বা অবিবেচক যাই হোক না কেন, তাঁর করুনার দানকে অস্বীকার করার মধ্যে কোন সন্তানের নাই।
পার হয়ে আসা জীবনটাকে যখন খতিয়ে দেখা হয় তখন জানান ঘটনা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অদ্ভুত ব্যবহারে তার প্রতিটি ঘটনায় কোন না কোনভাবে মা জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে দিল বলেই হয়তেব ঘটনাগুলি কোনটাই ভয়াবহ রূপ নিতে পারেনি। বট গাছে শালার মতো শালা বিস্তার করে সন্তানকে আসলে রেখেছেন মমতাময়ী মা।

যে জীবন পেয়ে মানুষ ধন্য, যে জীবন পেয়ে মানুষ এ সুন্দর পৃথিবীর অফুরন্ত সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখার সুযোগ পায়, সেই জীবনের জন্য অবশ্যই সবাই মায়ের কাছে ঋণী।

কিন্তু সব সময় কি তা সম্ভব হয়? সংসারের জটিলতায় সন্তান কখনও হয়ে ওঠে নরপশু। স্বার্থের হিং¯্রতায় ভুলে যা সে মমতাময়ী মায়ের মুখ। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে মায়ের কোমল মন, সন্তানের হাতে প্রহৃত হয়ে ঘরছাড়া হয়েছে অনেক মা। আশ্রয় নিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে, তাঁর বুকের গভীরে, অনেক অতলে কোথায় যেন একটা রক্তক্ষরন হয়ে চলে। বৃদ্ধাশ্রমের বিছানায় শুয়েও নিজেকে হঠাৎ কেমন নিরাশ্রয় মনে করেন। অভিমান হয়, কান্না পায় ভাবেন, পৃথিবীতে তাঁর জন্য কোথাও একটা সুখী গৃহকোন নেই।

সংসারের এতটুকু ছন্দপতনে সবার আগে মাই হয়ে যান অপরাধী। সব দোষ তাঁর কাঁধে চাপবার মধ্যে একটা বিজাতীয় সূখ পাওয়া যায়। কারন মা কখনো প্রতিবাদ করবে না। মা সন্তানের অন্যায়কে কখনো আঙ্গুল দিয়ে তুলে ধরবে না।নীরবে সবটুকু দু:খ কষ্টকে আলিঙ্গন করবে সংসারের পথচলার জন্য। যেন ‘‘জলের তোড়ে ভেসে আসা একটা বিষাক্ত সাপ দংশন করলে মায়ের সাথে, যে মা পাকি প্রতিনিয়তই সংসারের অন্য দংশনে দুশিত হচ্ছিল”।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক আশাপূর্না দেবীর ‘‘সুবর্নলতা উপন্যাসে মা সত্যবতী চলেছেন, ‘‘সুবর্ন আমি এটা তোর জন্য কাঁদিনা, এদেশের হাজার হাজার সুবর্নর জন্য কাঁদি, প্রতিবাদ করি, “মারা এমনই হয়ে থাকে, তাই বলা হয়” কুজন যদিও হয়, কুমাতা কখনও নয়”।

হাঁটি হাঁটি পাপ করা সন্তান পায়ের নীনের মাটি শক্ত হবার পর মায়ের হাত ছেড়ে দেয়, স্বার্থের পঙ্কিলতায় মায়ের নি:স্বার্থ ভালবাসা, স্নেহ, আদর, সোহাগ এক নিমিষে যে ভুলে যায়। কথার বাচন মা জর্জরিত হন, তারপরেও দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে সন্তানের কাজের জন্য ক্ষমা চান, কারন তিনি জানেন, মায়ের জন্য ক্ষমা চান, কারন তিনি জানেন, মায়ের ১ ফোটা দীর্ঘশ্বাস আল্লাহর ‘‘আরশ’’ কাঁপিয়ে দেয়। সাহিত্যিক বানী বসুর “শ্বেত পাথরের থানা” উপন্যাসের নায়িকা বন্দনা অপমানে, আঘাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি অনার্থ আশ্রমে। ছেলে ফিরিয়ে নিতে এলেও বলেছিলেন, এদের এই নি:স্বার্থ মা” ডাক ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না” বুঝতে হবে “মা” এত সুন্দর ডাকটি পেছনেও কখনো স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। মায়ের শরীরের অংশ নিয়েই আমরা পৃথিবীতে এসেছি। মা শুধু মাই হয়, তাই করি মুখে বলতে হয়,
“মায়ের সুশে আদর শাসন,
মায়ের বুকে রাজ সিংহাসন,
সেই মায়েরে পা চিনে যে
সেতো অর্বাচনী”
মায়ের আঁচল আমাদের সবচাইতে নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য আশ্রয়, আমাদের মনের হদিস, প্রাণের কথা, আমরা না বুঝলেও মা বুঝে, তাই পৃথিবীতে মাই শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সেই সম্পদকে সন্তানরা যেন বুক দিয়ে আগলে রাখতে পারে।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ
সরকারী জিয়া মহিলা কলেজ, ফেনী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!