দৈনিক ফেনীর সময়

জনগণের সঙ্গে ছক্কা-পাঞ্জা নিয়তি না কর্মফল

জনগণের সঙ্গে ছক্কা-পাঞ্জা নিয়তি না কর্মফল

দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর ক্ষুদ্ধ হয়েছে দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ। মহামারীর অভিঘাত শেষ না হতেই ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই সরকার একসাথে চার ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিলো এক লাফে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা। পেট্রোলের দাম ৫১.১৬শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটারের দাম হয়েছে ১৩০ টাকা। আর অকটেনের দাম বেড়েছে ৫১.৬৮শতাংশ, প্রতি লিটার ১৩৫ টাকা। যদিও এর আগে গত ৩ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৮০ টাকা।

অবশেষে দেশের সকল মহলের প্রতিবাদ-সমালোচনার মুখে সম্প্রতি সরকার ডিজেল-অকটেন-পেট্রল কেরোসিনের দাম পূনঃনির্ধারন করে লিটারে ৫ টাকা করে কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। নতুন দাম অনুযায়ী এখন ভোক্তা পর্যায়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ১১৪ টাকা থেকে কমে ১০৯ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা থেকে কমে ১৩০ টাকা, পেট্রোল ১৩০ টাকা থেকে কমে ১২৫ টাকা এবং কেরোসিন ১১৪ টাকা থেকে কমে ১০৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘জনগণের সঙ্গে তামাশা’ বলছে বামসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলছে,বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিম্নমুখী এবং বিপিসির আর্থিক হিসাবের অসঙ্গতি দূর করলে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না। জনমনের অসন্তোষকে প্রশমিত করার নামে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা কমানোর যে ঘোষণা সরকার দিয়েছে, তাও জনগণের সঙ্গে তামাশা এবং ব্যবসায়ীদের সুবিধা বৃদ্ধির নতুন পাঁয়তারা। সরকারের জ্বালানি নীতি ও কৌশল ভুল, দুর্নীতিগ্রস্ত ও লুটেরাবান্ধব।

বাম নেতাদের এইসব বক্তব্য অবশ্য সরকারকে আমলে নিতে দেখা যায়নি। তবে এটা সত্য, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ও কমানো নিয়ে সরকারের বর্তমান কার্যক্রম সাধারণ মানুষের সঙ্গে এক ধরনের মশকরাই।

সরকার ভালো করেই জানে, জ্বালানির সঙ্গে দেশের অর্থনীতি-দ্রব্যমূল্য-খাদ্য নিরাপত্তার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তারপরও সরকার এই খাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়েছে বলে মনে হয়নি।

এদিকে ডিজেলের দাম কমানোর ফলে, বিআরটি ও পরিবহন মালিকদের সাথে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সাথে ভাড়া পুর্ননির্ধারণ কমিটির বৈঠকে কিলোমিটার প্রতি বাস ভাড়া মাত্র ৫০ পয়সা এবং লঞ্চে ভাড়া পাঁচ পয়সার তিনগুণ পনেরো পয়সা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অংকের কী দূর্দশা ? অতিতে ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়লে বাস ভাড়া কিলোমিটারে বাড়ানো হয়েছে ৩৮ পয়সা ; অথচ ডিজেলের দাম ৫ টাকা কমাতে বাস ভাড়া কমানো হলো কিলোমিটারে ৫ পয়সা।

ইহজনমেও এই অঙ্কের কথা শুনেনি কেউ! ফলে পাঁচের এই কিছিমের প্যাঁচানো তামাশায় মানুষ আরো ক্ষুব্ধ হয়েছে।

বর্তমানে রাজধানীর ও দূরপাল্লার ডিজেল চালিত বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে পাঁচ পয়সা কমাতে, দূরপাল্লার বাসে ২ টাকা ১৫ পয়সা এবং মহানগরে ২ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিআরটিএ। এর আগে, কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধে শর্তসাপেক্ষে সীমিত পরিসরে নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রী নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের মে মাসের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার চলাচলকারী প্রতি কিলোমিটারের সর্বোচ্চ ভাড়া ছিল ১ টাকা ৪২ পয়সা। করোনাকালে ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে তা ২ টাকা ২৭ পয়সা নির্ধারিত হয়েছিল। ঢাকা মহানগরীতে বাস ও মিনিবাসের চলাচলের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপন অনুসারে ভাড়া ১টাকা ৭০ পয়সা এবং চট্টগ্রামে ১ টাকা ৬০ পয়সা। সেই সময়ও ভাড়া বাড়ানোর সময় ভোক্তা ও নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলো আপত্তি করেছিল। কারণ করোনাকালে পৃথিবীর কোথাও গণপরিবহনে যাত্রীভাড়া বাড়ানো হয়নি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেসময় বিআরটিএ কর্তৃক নির্ধারিত ভাড়ার চাইতেও বাস্তবে অনেক বেশি ভাড়া আদায় করা হয়েছিলো।

এমনিতেই মানুষ পরিবহন সংশ্লিষ্টদের কাছে জিম্মি। তারওপর এই সময় মাত্র পাঁচ পয়সা কমানোর নিষ্ঠুর মশকরা। অথচ বাস্তবে কিন্তু নেয়া হচ্ছে আগের ভাড়াই।

এমন বেদনাময় সময়ে আবার ক্ষমতার শীর্ষমহল থেকে অবিরাম খোঁচা। তাও আবার প্রধানমন্ত্রীর নাম জড়িয়ে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক হাইপ্রোফাইল মন্ত্রীর ভাষায় : দাম কমানোর নজির সৃষ্টি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ দাম বাড়ানোর কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, ‘আমাদের পেট্রোল ও অকটেন আমদানি করতে হয় না তাই এগুলোর দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নাই” তাহলে দাম কার স্বার্থে বাড়ানো হলো? প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা আবার তামাশার মধ্যে ভিন্ন মাত্রার ঘি ঢেলেছেন। তার মতে, তেলের দাম ৫ টাকা বাড়ানো-কমানোর কোনো প্রভাব নেই। বরং যতোটুকু বাড়ানো হয়েছিল সেটাই রাখা উচিৎ ছিল।

এ মুল্লুকের মানুষের সঙ্গে কতো কিছু করা যায়। যা ইচ্ছা বলা যায়। পাঁচ টাকা-পাঁচ পয়সা বাড়ালে সমস্যা হয় না। বাস্তবতা হলো, ঘোষণার আগেই মারপ্যাঁচে তা কার্যকর হয়ে যায়। কিন্তু কমানোর ঘোষণা দিলে কমে না। কমানো হয় না। পাই পয়সার প্রচলন কবেই বাঘে খেয়েছে ? বাস-লঞ্চে যাত্রী বা কন্ডাকটার-কাউন্টার কারো কাছে তো নয়ই। ঢাকা থেকে কক্সবাজারের ড্রাইভিং দূরত্ব ৩৯৩ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটারে বাস ভাড়া ৫ পয়সা সত্যি-সত্যি কমানো হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যেতে বেঁচে যাবে ১৯ টাকা ৬৫ পয়সা এবং ফিরে আসতেও বাঁচবে ১৯ টাকা ৬৫ পয়সা। মোট বেঁচে যাওয়া অংকটি হচ্ছে, ৩৯ টাকা ৩০ পয়সা সরকারের কেন দরকার হয়ে গেল মানুষের সঙ্গে এমন মশকরার ? এর জবাব খুঁজতে রুটিওয়ালার রাজ্যের রাজার লুটগণিতের গল্পটি বেশ বাজার পেয়েছে। ওই রাজার রাজ্যে রুটি বিক্রেতারা ৫ টাকার রুটি ১০ টাকা করার ইচ্ছা করলেও সাহস পাচ্ছিল না গণপিটুনির ভয়ে। তাদের নেতারা বুদ্ধি করে রাজার শরনাপন্ন হন। রাজা বললেন, কিসের ১০ টাকা। যা, কাল থেকে ৩০ টাকা করে দে। রুটিওয়ালারা হতবাক। রাজা কঠোর দিলেন, নিশ্চিন্তে রুটির দাম ৩০ টাকা করে দে। তবে, আমি যে দাম বাড়াতে বলেছি, সেটা কাউকে বলবি না। রুটিওয়ালারা তাই করলো। সারা রাজ্যে প্রতিবাদ। ক্ষ্যাপা জনতা ছুটে যায় রাজার কাছে। কান্নাকাটি করে রুটিওয়ালাদের উচিৎ শিক্ষা দেয়ার দাবি জানায়। রাজা হুংকার দিয়ে রুটি ওয়ালা নেতাদের ধরে আনালেন। এই অন্যায় বরদাশত করবেন না তিনি। তারপর ঘোষণা দিলেন কাল থেকে রুটির দাম অর্ধেক ১৫ টাকায় নামাতে হবে। সারা রাজ্যে রাজাকে নিয়ে ধন্য ধন্য রব। জনগণ খুশি। লুটগণিত বুঝে রুটিওয়ালারা মহাখুশি। কষ্টের সময়ে জোকসে বুদ হয়ে নিজেকে হালকা করা পর্যন্ত। ফেসবুক ব্যবহারকারী অন্ততঃ পোস্ট করার একটা টপিক তো পেলো। যত বেশি ইস্যু, তাদের তত বেশি পোষ্ট। তবে জনগণ নামের জীবরা তত বোকা নয়। বোঝে, কিš‘ করার কিছু নেই। না রাজা, না রুটিওয়ালা কাউকেই কিছু করার হিম্মত নেই তাদের। সবকিছুর দাম বাড়ে, তাদের বাড়ে না। তারা বাড়তি দামে কিনতে বাধ্য।

নো টক অবস্থার এই জনগণ জানে, বাংলাদেশে আধুলি, মাধুলি, কয়েনের যুগ আসবে না। এরপরও ধন্য-ধন্য বাহবা দিতে হবে। এক টাকায় আট মণ চালের বাস্তবতা না থাকলেও, পেটে ভাত না থাকলেও মত্ত হতে হবে শায়েস্তা খার জজবায়। খাদ্যমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, চাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়। কিন্তু বলতে হবে চালের দাম কেজিতে দুয়েক টাকা কমেছে বা স্থিতিশীল আছে। সরকারি মহল থেকে যেন প্রচার করা হচ্ছে, সারা বিশ্বে যখন মূল্যবৃদ্ধির হিড়িক, বাংলাদেশে তখন চলছে মূল্যহ্রাস উৎসব। জনগণের সঙ্গে লুটগণিতের এই ছক্কা-পাঞ্জা নিয়তি না কর্মফল, আজাব না গজব-এ নিয়েও যুক্তি ও কথার শেষ নেই। সত্তর-আশির দশকে চাল বা লবনের দাম বেড়ে গেলে সামাজিক হৈ চৈ পড়ে যেত। নব্বইয়ের দশকে যোগ হয় পেঁয়াজ-রসুনের দাম। পরবর্তীতে যোগ হয় শাক সব্জি, কেরোসিন। বিগত কয়েক বছর ধরে বাঙালির উৎকণ্ঠার তালিকায় মাছ, মাংস, ডিম, তেল মাড়িয়ে এখন জ্বালানিতেও আর তেমন জ্বালা ধরে না। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখলেই ল্যাঠা মিটে যায়।

সম্প্রতি ডিমের দাম নিয়ে হৈ চৈ হওয়া প্রমান করে কেবল শর্করা নয়, বাঙালির দৈনিক বাজারের থলিতে এখন প্রোটিনও যোগ হয়েছে। যদিও এমনটি হয় কোনো জাতির ক্রয় ক্ষমতা বাড়লেই। তখন তাদের ম্যাক্রো – মাইক্রো ইকোনমিক্সের বোধ থাকে না। জিডিপি, মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধির হিসাব দেখার তো সময়ই পায় না। জ্বালানি তেলের দাম পঞ্চাশ টাকা বাড়িয়ে এখন পাঁচ টাকা কমানোর গণিত বোঝার সময় কই তাদের ?

এখন চোখেমুখে উদ্বেগ নিয়ে দেশের বেশীরভাগ সচেতন মানুষের প্রশ্ন, বাংলাদেশও কি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে? শ্রীলঙ্কায় তো সরকার দেউলিয়া হয়েছে, বাংলাদেশে কি সাধারণ মানুষ দেউলিয়া হবে?

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!