দৈনিক ফেনীর সময়

সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সম্মানজনক

সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সম্মানজনক

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান

পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও সম্মানজনক পেশা সাংবাদিকতা। এ পেশায় আকৃষ্ট হয়েছি বহু আগে। কাজ করছি প্রায় তিন দশক ধরে। যতদূর মনে পড়ে- ছোটবেলা থেকেই আমাদের ঘরে প্রচুর বই পুস্তক ও পত্রিকা দেখে আসছি। ষাটের দশকের জনপ্রিয় মুখপত্র সাপ্তাহিক তা’লিম এর সম্পাদক ছিলেন আমার বাবা। তিনি খুব পড়–য়া ছিলেন। প্রতিদিন ঘরে বিভিন্ন পত্রিকা নিয়ে আসতেন। এসব পত্রিকা নিয়মিত পড়তাম। বাবা রাজনীতি করার কারণে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠাতেন। তিনি মুখে বলতেন, আমি লিখতাম। এভাবে দিন গড়াতে গড়াতে একদিন আমার মধ্যে লিখায় আগ্রহ তৈরি হয়। জাতীয় কবি নজরুলের জন্মদিনে একটি কবিতা লিখে দৈনিক ইনকিলাবে পাঠালে তা সাহিত্য পাতা সোনালী আসরে ছাপা হয়। এতে লিখার আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে আরো কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় আমার লিখা বিভিন্ন প্রবন্ধ ও কবিতা স্থান পায়।

লেখালেখির সুবাদে সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার একটা বন্ধন গড়ে উঠে এবং সে বন্ধন থেকে এক সময় সাংবাদিকতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। তবে চ্যালেঞ্জিং এ পেশা কিভাবে শুরু করা যায় এমন কোন ধারণা ছিল না। একদিন সাপ্তাহিক স্বদেশ কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক খলিলুর রহমানের অফিসে গেলাম কয়েকটি সমস্যামূলক বিষয় নিয়ে। সময়টা ১৯৯৩ সালের গোড়ার দিকে। তখন আমি ১৯ বছরের টগবগে যুবক। পরিচয় দিতেই খলিল ভাই বসতে বললেন। ওই সময় তিনি পত্রিকার একটি নিউজের প্রæপ দেখা নিয়ে ব্যস্ত। একটু পরেই পত্রিকা প্রেসে উঠবে এ রকম। ওই সময় কম্পিউটার কম্পোজ ও অফসেট প্রেস ছিল না। স্বদেশ কণ্ঠ তখন ছাপা হতো স্টেশন রোডে বকু হাজারীর লেটার প্রেসে। লেটার প্রেস ও হ্যান্ড কম্পোজের সাথে আমার পরিচয় আরো বছর দুয়েক আগে। ফেনী সরকারি পাইলট হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার পর কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘বর্ণমালা’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করেছিলাম। ম্যাগাজিনটি শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়কের কাজী মোমিন ভাইয়ের ন্যাশনাল প্রেসে ছাপা হয়েছিল। ম্যাগাজিন প্রকাশে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন আমার শ্রদ্ধাভাজন পিতা, প্রবীন আলেম ও শিক্ষাণুরাগী মাওলানা মুহাম্মদ আবদুস সাত্তার। বর্ণমালায় ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন হাজারী, বরেণ্য শিক্ষাবিদ, ফেনী সরকারী কলেজের অধ্যাপক ও লেখক রফিক রহমান ভ‚ঁইয়া, মনজুর তাজিম, এডভোকেট জাহিদ হোসেন খসরু, এডভোকেট জাফর উল্যাহ খানসহ নবীন-প্রবীন অসংখ্য লেখকের নতুন নতুন প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, ছড়া ও কৌতুক দিয়ে সাজানো হতো। সাদাকালোয় ছাপা ম্যাগাজিনটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। বর্ণমালা সম্পাদনা করার সুবাদে হ্যান্ড কম্পোজ, প্রæপ দেখা ও লেটার প্রেস বিষয়ে কিঞ্চিত ধারণা পাই।

যাই হোক- নিউজের প্রæপ দেখা শেষে স্বদেশ কণ্ঠ’র বার্তা সম্পাদক মাঈনুদ্দিন ভাইকে সব বুঝিয়ে দিয়ে খলিল ভাই আমাকে বললেন, ‘ইয়াংম্যান- কি জন্য এসেছ বল।’ আমি কয়েকটি সমস্যার কথা তুলে ধরতেই তিনি বললেন, ‘যে সমস্যাগুলোর কথা বলেছ, সেগুলো থেকে প্রথমে যে কোন একটি বিষয় তোমার মতো করে কাগজে লিখে আনবে, আমি দেখবো।’ সেদিন খলিল ভাইয়ের কথায় বেশ উৎসাহ পেয়েছিলাম। লিখতে তেমন না পারলেও কিছু একটা লিখার প্রতি আগ্রহ জন্মালো। সে থেকে স্বদেশ কণ্ঠ অফিসে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলাম। আমার আগ্রহ দেখে খলিল ভাই নিজেই আমাকে শিখানোর জন্য সময় দিতেন। গুণি এ সম্পাদকের হাত ধরেই সাংবাদিকতায় জড়িয়ে গেলাম। সে থেকে সাপ্তাহিক স্বদেশ কণ্ঠ’র শহর প্রতিনিধি ও স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছি। একক দায়িত্বে ছাপিয়েছি পত্রিকাটির ২-৩টি সংখ্যা। একদিন স্বদেশ কন্ঠ’র প্রথম পাতায় আমার নামসহ একটি নিউজ ছাপা হল। হঠাৎ করে পত্রিকায় বাইনেমে নিউজটি দেখে অনেকে আমার খোঁজ নিলেন। নিউজ প্রকাশের পর খোশ মেজাজে থাকায় সম্পাদক খলিল ভাই বললেন, সময় পেলেই বেশি বেশি পত্রিকা পড়বে ও কিছু লিখার চেষ্টা করবে এবং যা লিখলে তা পড়ে দেখবে। খলিল ভাই আজ নেই। তার কথাগুলো স্মৃতির আয়নায় ভাসছে আজও। স্বদেশ কণ্ঠ’র পাশাপাশি ১৯৯৪ সালে আমি দেশের স্বনামধন্য সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার ফেনী জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। বাংলাবাজার পত্রিকায় তখন আমার সাথে জাহানআরা বেগম সুরমা আপাও জেলা প্রতিনিধি প্রার্থী হয়ে কিছুদিন নিউজ পাঠিয়েছিলেন।

আমি যখন সাংবাদিকতা শুরু করি দেশে তখন এত পত্রিকা ছিল না। বিটিভি ছাড়া ছিল না অন্য কোন টেলিভিশন চ্যানেলও। ইলেকট্রনিক মিডিয়া কারো কল্পনাতেই আসেনি। সারা বিশ্বের মানুষের তখনো ইন্টারনেট, অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যম অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না। তবে বহু গুণী সাংবাদিকের জন্মস্থান ফেনী। এ জেলা থেকে তখন বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক ও একটিমাত্র অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো। সাতদিন পর ছাপা হলেও ওই পত্রিকাগুলোর জন্য পাঠকরা অধির আগ্রহে মুখিয়ে থাকতেন। যেদিন যে সাপ্তাহিকটি বের হতো তার চুম্বক অংশ সুরে সুরে বলে হকাররা পৌছে দিতেন পাঠকের হাতে।

এখনও সাংবাদিকতায় আছি। তবে আমার সাংবাদিকতা শুরুর সময়ের সাথে এখনকার সাংবাদিকতার বিস্তর ফারাক। তখন নিউজ কপি-পেস্ট করার সুযোগ ছিল না। সবাই নিজের মত করে সংবাদ লিখতেন। সংবাদের খোঁজে ঘুরে বেড়াতেন এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে। সিনিয়রদের সাথে আমিও ঘুরেছি। একদিন সংবাদ সংগ্রহে গিয়েছিলাম পরশুরামের বিলোনীয়া সীমান্তে। সঙ্গি ছিলেন দৈনিক ইনকিলাবের আবদুল হক ভাই, ইত্তেফাকের ছাগলনাইয়া সংবাদদাতা এইচ.এম জামাল উদ্দিন ও ইউএনবি’র ঢাকা অফিসের রেজাউল করিম ভাই। তখন ভারত সংলগ্ন মুহুরীর চরের ১১১ একর বিরোধপূর্ণ জায়গা নিয়ে বিডিআর (বিজিবি)-বিএসএফ মুখোমুখি। আগেরদিন বিএসএফ’র গুলিতে নীরিহ এক বাংলাদেশী কৃষক প্রাণ হারান। আমরা ওই কৃষকের পরিবারের লোকজন ও গ্রামবাসীর সাথে কথা বলেছিলাম। কথা বলেছিলাম ফোর বিডিআর প্রধান লে: কর্ণেল মুকাইদুল ইসলামের সঙ্গে। সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে একটি প্রতিবেদন তৈরী করে পাঠালাম বাংলাবাজার পত্রিকায়। পরেরদিন তা পত্রিকার প্রথম পাতায় সেকেন্ড লিড হল। বাইনেমে ছাপা আঞ্চলিক ভাষায় নিউজটির শিরোনাম ছিল- ‘ইয়েনে এতো যুদ্ধ ছলের কেঅ এক নজর ছাইলো না।’ মফস্বলের সংবাদ হলেও সেটি অধিক গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল। যা নিয়ে জাতীয় সংসদেও আলোচনার ঝড় ওঠে। এছাড়াও গোল্ড মেডেল পাওয়া আনন্দপুর ইউপির তৎকালীন চেয়ারম্যান (ফেনী জেলা পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান) আজিজ আহমদ চৌধুরীর একটি বিশেষ সাক্ষাতকার বাংলাবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়। ফেনী অঞ্চলের সংবাদ যে কোন পত্রিকায় প্রধান্য দিয়ে ছাপা হয়। বাংলাবাজার পত্রিকার সম্পাদক (বর্তমান মানবজমিন সম্পাদক) মতি ভাই আমাকে প্রায় সময় বলতেন ‘দেশসেরা বহু কলম সৈনিক উঠে এসেছেন ফেনী থেকে, ফেনী নিউজের কারখানা, এ জেলার মানুষ সর্বক্ষেত্রে সবার বেশ এগিয়ে।’

বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি দিক দিয়ে বর্তমানে ব্যাপকভাবে এগিয়েছে। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ায় যে কোন খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে দিক-দিগন্তে। এর সুফল পা”েছন সংবাদকর্মীরাও। তবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের আগে সাংবাদিকরা পত্রিকায় নিউজ পাঠাতেন হাতে লিখে। আমি নিজেও কাগজের এক পৃষ্ঠায় সংবাদ লিখে ঢাকায় পাঠাতাম, অন্য পৃষ্ঠা সাদা থাকতো। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে সেটি বুকপোস্টে পাঠাতাম। সেটি পত্রিকায় ছাপা হত ২-৩ দিন পর। কখনও জরুরী নিউজ হলে ফ্যাক্স করতাম। কারেন্ট নিউজ হলে টেলিফোন ভবনে গিয়ে অফিসের এনালগ নাম্বারে ‘অর্ডিনারী প্রেস কল’ বুকিং দিয়ে এক-দেড় ঘন্টা সময় অপেক্ষা করতে হতো। প্রায় সন্ধ্যায় এক পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে আরেক প্রতিনিধির দেখা হতো টেলিফোন ভবনে। তখন দৈনিক ইত্তেফাকের মাহবুবুল হক পেয়ারা দাদা, দৈনিক ইনকিলাবের আবদুল হক, জনকণ্ঠের ওসমান হারুন মাহমুদ দুলাল, দৈনিক বাংলার শাহজালাল রতন, দৈনিক দিনকালের হাবিবুর রহমান খান, বাংলার বাণী’র যতন মজুমদার, দি নিউ নেশনের এইচ.এম জামাল উদ্দিন, ডেইলি অবজারভারের ডা. ছিদ্দিক উল্যাহ, ভোরের কাগজের মানিক লাল দাস, আজকের কাগজের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও হাজারিকার বিধান মজুমদার সুমনসহ ফেনীর খ্যাতিমান সাংবাদিকদের সাথে কাটানো স্বল্পদিনের অনেক সুখস্মৃতি আজও মনের আঙ্গিনায় উঁকি দেয়। স্বদেশ কণ্ঠ, হাজারিকা, ফেনী বার্তা, জাতীয় বার্তা, রৌশনাবাদ ও মুহুরী ছিল তখনকার উল্লেখযোগ্য সাপ্তাহিক পত্রিকা। এসব সাপ্তাহিকের সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সাথে রয়েছে অনেক স্মৃতি। সেসব স্মৃতি একপাশে ফেলে জীবিকার তাগিদে হুট করে একদিন চলে গিয়েছিলাম রাজধানীতে। সেখানে এক নাগাড়ে কাটিয়েছি দুই দশক। সুদীর্ঘ এ সময়ের শুরুতে কিছুদিন দৈনিক আল আমীন পত্রিকার নিউজ ডেস্কে ও পরে পুরানা পল্টনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রেস সেক্রেটারী জাওয়াদুল করিমের সাপ্তাহিক ছুটিতে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। এছাড়াও স্বল্প সময় পার্টটাইম কাজ করেছি দৈনিক আল মুজাদ্দেদ ও মানবজমিনে।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে তরুণ ব্যবসায়ী ও বর্তমান ১০নং ওয়ার্ড পৌরকাউন্সিলর খালেদ খান সাপ্তাহিক ফেনীর গৌরব পত্রিকাটি কামাল উদ্দিন ভ‚ঁইয়া থেকে মালিকানা পরিবর্তন করে দৈনিক ফেনীর সময়ের সাবেক স্টাফ রিপোর্টার (বর্তমানে প্রভাত আলোর বার্তা সম্পাদক) এম.এ জাফর ভাই ও আমার হাতে তুলে দেন। কিছুদিন কাজ করার পর জাফর ভাই সময় দিতে না পারায় এ সাপ্তাহিকটিকে ধারাবাহিকভাবে একাই টেনে এনেছি। সে থেকে ফেনীর গৌরবের স্টাফ রিপোর্টার থেকে বার্তা সম্পাদক হয়ে পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। পাশাপাশি কাজ করছি জাতীয় দৈনিক আমার সংবাদে। ১০ বছরে পা রাখা আমার সংবাদ ডিএফপি’র বর্তমান তালিকার শীর্ষ দশম স্থানে রয়েছে। পাঠকপ্রিয় এ পত্রিকাটির অনলাইন ও প্রিন্ট ভার্সনে নিয়মিত আমার নিউজ ছাপা হচ্ছে। এ পত্রিকায় আমার বেশ কয়েকটি নিউজ ও প্রতিবেদন লিড ও সেকেন্ড লিড আকারে ছাপা হয়েছে। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০২০ সালে আমাকে বর্ষসেরা প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয় এবং প্রতিনিধি সম্মেলনে আমার সংবাদ সম্পাদক ও প্রকাশক হাশেম রেজা ক্রেস্ট এবং সনদ প্রদান করেন।
সংবাদপত্রে দীর্ঘ সময় পার করলেও বড় মাপের সাংবাদিক নই। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত সাংবাদিকতা পেশার মাধ্যমে তথ্য ও সত্যকে পত্রিকার পাতায় নির্ভয়ে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।

লেখক : ফেনী প্রতিনিধি, দৈনিক আমার সংবাদ
নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক ফেনীর গৌরব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!