দৈনিক ফেনীর সময়

যিলহজ মাসের প্রথম দশকের মুমিনের করনীয়

যিলহজ মাসের প্রথম  দশকের মুমিনের করনীয়

আরবি দ্বাদশ মাস হলো যিলহজ। এ মাস চারটি সম্মানিত মাসের অন্যতম। এটি হজের মাস, ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার মাস, প্রভুর সান্নিধ্য লাভের মাস। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- অবশ্যই আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারটি; তন্মাধ্যে চারটি হারাম বা সম্মানিত মাস, এটা সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান (সূরা: তাওবা- ৩৬)। সম্মানিত চারটি মাস হলো- যিলকদ, যিলহজ, মহররম ও রজব।

এ মাসের মহত্ব ও ফযীলত প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত আছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- আল্লাহর নিকট যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোন দিনের আমল উত্তম নয়। সাহাবায়ে কিরাম আরজ করেন- হে আল্লাহর রাসূল (স)! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও না? রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও না- তবে ঐ ব্যক্তি ছাড়া, যে তার সর্বস্ব নিয়ে জিহাদে অংশগ্রহন করল এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসতে পারেনি (বুখারী)। মহান আল্লাহর সš‘ষ্টি অর্জনে একজন মু’মিনের কর্তব্য পবিত্র কুরআনের আলোকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (স)-এর পরিপূর্ণ আনুগত্য করে পুণ্য কাজের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এ দশদিন অতিবাহিত করা। হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স) বলেছেন, আল্লাহর নিকট ইবাদতের জন্য যিল হজের দশ দিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোন দিন নেই। জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও কি এর সমান নয়? মহানবী (স) প্রত্যুত্তরে বলেন- না। তবে যদি জিহাদে কারো ঘোড়া আহত হয় এবং স্বয়ং মুজাহিদ ধূলি-মলিন হয়, তবে তার জিহাদ উল্লিখিত দিনগুলোর আমলের সমান হতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আল্লাহ তা’য়ালা দিবস সমূহের মধ্যে চারটি দিবসকে সম্মানিত করেছেন- জুমাবার, আরাফার দিন, ঈদুল আযহার দিন, ও ঈদুল ফিতরের দিন। ইবন কাসির বলেছেন সূরা ফজরের এক ও দুই আয়াতে তথা শপথ প্রভাতের, শপথ দশ রাতের, যে দশ রাতের কথা বলা হয়েছে, তা জিলহজের প্রথম দশক উদ্দেশ্য (ইবন কাসির চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ৫৩৫)।

মুমিনের করনীয় : যিলহজ মাসের প্রথম দশকে মুমিনের জন্য অনেক গুলো কাজ অত্যাবশ্যক। যেমন- রোযা রাখা ঃ ইমাম নববী (র) বলেন, এ মাসের প্রথম ৯দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। বিশেষ করে যে ব্যক্তি হজে যায়নি তার জন্য আরাফার দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক যুবকের অভ্যাস ছিল যে, সে যিলহজ মাসের চাঁদ দেখা দিলেই রোযা রাখতো। মহানবী (স) তা জানতে পেরে যুবককে জিজ্ঞেস করেন, হে যুবক! তুমি কেন এ দিনগুলো তে রোযা রাখ? সে প্রত্যুত্তরে বলল- হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, এ দিবস সমূহ পবিত্র হজের প্রতীক ও হজ আদায়ের মুবারক সময়। হজ আদায়কারীর সাথে আমিও নেক আমলের আশায় অংশীদার হই, তার সাথে আমার দোয়া আল্লাহ তা’য়ালা কবুল করে নিবেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (স) বলেন- তোমার একেকটি রোযার বিনিময়ে একশত দাস আযাদ করার, একশ উট দান করার এবং জিহাদের সাজে সজ্জিত একটি ঘোড়া জিহাদের জন্য দান করার সাওয়াব প্রাপ্ত হবে। আরাফাতের দিন তথা- যিলহজের রোযার বিনিময়ে দু’হাজার দাস মুক্ত করার, দু’হাজার উট দান করার, জিহাদে সজ্জিত দু’হাজার ঘোড়া দান করার পুণ্য প্রাপ্ত হবে। (মুকাশাফাতুল কুলুব- ইমাম গাজ্জালী)। অপর হাদীসে মহানবী (স) বলেছেন- আরাফাতের দিন তথা ৯ যিলহজের রোযা দু’বছর রোযা রাখার সমতুল্য, আর আশুরার রোযা এক বছর রোযা রাখার সমতুল্য।

আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- আর আমি হযরত মুসা (আ)- এর সাথে ত্রিশ রাতের অঙ্গীকার করেছি এবং তা পূর্র্র্ণ করেছি আরো দশ দ্বারা (সূরা: আরাফ- ১৪১)। মুফাসসিরদের মতে সে দশ দিন ছিল যিল হজ মাসের প্রথম দশ দিন। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আল্লাহ দিবস সমূহের মধ্যে চারটি দিবস, মাস সমূহের মধ্যে চার মাস, নারীদের চার জন, সর্বাগ্রে জান্নাতে প্রবেশ কারী চার জন এবং জান্নাত যে সব নেক বান্দার প্রত্যাশী তাদের মধ্যে চার জনকে নির্বাচন করে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। চারটি দিবস হলো- জুমাবার, আরাফাতের দিন, ঈদুল আযহার দিন ও ঈদুল ফিতরের দিন। চারটি মাস হলো- রজব, যিলকদ, যিলহজ ও মহররম। মহিয়ষী চারজন নারী হলেন- হযরত মরিয়ম বিনতে ইমরান (আ) হযরত খাদেজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা), হযরত আছিয়া বিনতে মাযাহিম (আ), হযরত ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (স)। সর্বাগ্রে যারা জান্নাতে প্রবেশ করবেন সেই সৌভাগ্যবান চারজন হলেন- হযরত মুহাম্মদ (স), পারস্যবাসীদের মধ্যে- হযরত সালমান ফারসী, রোমীদের মধ্যে হযরত সোয়ায়ের রুমী (আ), হাবশাবাসীদের মধ্যে হযরত বেলাল (রা)। জান্নাত যাদের জন্য উদগ্রীব তারা হলেন হযরত আলী (রা), হযরত সালমান ফারসী (রা), হযরত আম্মার ইবন ইয়াসার (রা) (মুকাশাফাতুল কুলুব)। রাসূলুল্লাহ (স) আরো বলেন- যে ব্যক্তি ৮ যিল হজ রোযা রাখবে আল্লাহ তায়ালা তাকে হযরত আইয়ুব (আ)-এর ন্যায় কঠিন পরীক্ষায় ধৈর্য্য ধারণের সাওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি আরাফাতের দিন রোযা রাখবে, আল্লাহ তা’য়ালা তাকে হযরত ঈসা (আ)-এর ন্যায় সাওয়াব দান করবেন। মহানবী (স) থেকে আরো বর্ণিত আছে, যখন আরাফাতের দিন আসে তখন আল্লাহ তা’য়ালা তার রহমত ছড়িয়ে দেন। এ দিনে যে পরিমাণ লোকদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়, অন্য কোনদিন তা দেয়া হয় না। যে ব্যক্তি আরাফাতের দিনে রোযা রাখে তার বিগত বছর ও আগামী বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয় (মুসলিম)।

কুরবানী দাতার করণীয় : জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে কুরবাণী করা পর্যন্ত কুরবাণী দাতার চুল, মোচ, নখ, বগল ও অন্যান্য স্থানের লোম বা পশম না কাটা মুস্তাহাব। এ সর্ম্পকে হজরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জিলহজের চাঁদ দেখে এবং কোরবানির ই”ছা করে, সে যতক্ষণ কুরবানি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন চুল বা নখ না কাটে’ (সহিহ মুসলিম: হাদিস- ৩৬৫৬)। এ আমল মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। ফিকাহবিদগণ বলেছেন কুরবানি করার আগে নখ, চুল, গোঁফ ইত্যাদি না কাটার পেছনে হিকমত হচ্ছে হজযাত্রীদের সঙ্গে সাদৃশ্য করা। কারন, তাদের ইহরাম অবস্থায় এ সব কাটা নিষিদ্ধ। ইবনুল কায়্যিম (র.) বলেন, পশু কুরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের কিছু অংশ আল্লাহর সš‘ষ্টি অর্জনের জন্য কুরবানি (ত্যাগ) করার ব্যাপারে যেন সে অভ্যস্ত হয়, এজন্যই এ নির্দেশ।

তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা : জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে ১৩ তারিখের আসর নামাজ পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব। এটি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর সকল বালেগ, পুরুষ, মহিলা, মুকিম, মুসাফির, গ্রামবাসী, শহরবাসী, জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়কারী বা একাকী আদায়কারী প্রত্যেকের ওপর একবার করে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা কর্তব্য। (ফাতাওয়ায়ে শামি.বাহরুর রায়েক)।

এ তাকবির একবারের বেশি না বলা বাঞ্ছনীয়। কারণ একের অধিক বলার বিধান নেই। (তাহতাবি, পৃষ্ঠা নং- ২৯৪) তাকবিরে তাশরিক হলো- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহ আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ্।

পশু কুরবানী করা : এ দিনগুলোর দশম দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও কুরবানী করো।’ (সুরা: কাউসার, আয়াত: ২) সকল নবী রাসূলের যুগে কুরবানীর প্রচলন ছিল, তবে রীতি-নীতিতে ছিল ভিন্নতা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- আমি প্রত্যেক জাতির জন্যে কুরবানী নির্ধারন করেছি, যাতে তারা (জীবিকা হিসেবে) আল্লাহর দেয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে (সূরা হজ-৩৪)। সর্বপ্রথম কুরবানী করেছিলেন হযরত আদম আ. এর পুত্র হাবিল ও কাবিল। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- আর তাদেরকে আদমের পুত্রদ্বয়ের কাহিনী শুনিয়ে দিন, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, একজনের কুরবানী কবুল হয়েছে, অন্যজনের কুরবানী কবুল হয়নি (সূরা আল মায়েদা-২৭)।

লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!