দৈনিক ফেনীর সময়

সোনাগাজীর খেজুর রসের মৌ মৌ ঘ্রাণ ফেনীর বাজারে

কিশান মোশাররফ :

খেজুর রস- মিষ্টি, সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও উপাদেয়। ফেনীর গ্রামাঞ্চল তথা বাংলাদেশের আনাছে কানাছে একসময় খেজুর গাছ দেখতে পাওয়া যেত। এখন এই গাছ বলাচলে একরকম দুষ্পাপ্য হয়ে উঠছে। ফেনী শহর এলাকা ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ছোট বড় প্রায় সব গুলো বাড়ির পুকুর পাড়ে, ডেলার দ্বারে এই গাছ দেখতে পাওয়া যেত। শীতের সুস্বাদু রসের রাজা এই খেজুর গাছের আবাদ কালক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে। শীতের এই মৌসুমি রস সংগ্রহে একসময় বাড়ি বাড়ি ধুম পড়ে যেত। রসের শিন্নী, পায়েস, আধাজ্বালে তৈরি এক প্রকার গাঢ় রস আঞ্চলিক ভাষায় একে বলা হতো আধরৈয়া। আধরৈয়ায় ভিজিয়ে খোলা পিঠা বা চিতল পিঠা, সাদা ভাঁপা পিঠা খাবার মজাই ছিলো অন্য রকম। বর্তমানে খেজুর গাছের আবাদ কমে যাবার ফলে বর্তমান প্রজন্মের কাছে খেজুর গাছ ও এর রসের উপজীব্যতা যেমন অপরিচিত হয়ে উঠছে তেমনি পৌরাণিক গল্পের মতও মনে হতে পারে। বর্তমান বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেককেই শীত মৌসুমে স্মৃতিতে খেজুর রসের নানাবিধ খাবারের স্বাধের অপূর্ণতায় প্রায়শঃই হাপিত্যেষ করতে দেখা যায়। অনেকে সামান্য একটু স্বাদ নিতে দুর দুরান্ত থেকে রস সংগ্রহের চেষ্টা করে থাকেন। যেমন বসুরহাট কোম্পানিগঞ্জ, চাটখিল, লক্ষীপুরের চরাঞ্চল থেকে আত্মীয় পরিজন বন্ধু পরিচিত জনের মাধ্যমে সংগ্রহ করার কথা জানাযায়। তবে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আদর্শ গ্রাম নামক এলাকায় গড়ে উঠছে এক বিস্তৃত খেজুর পল্লী। গত কয়েক বছর ধরে আদর্শ গ্রামের খেজুর রস ফেনীর মানুষের মাঝে রসআস্বাধনের কিঞ্চিৎ যোগান দিয়ে আসছে।

খেজুরের কাঁচা রস সরবরাহকারী আদর্শ গ্রামের সাইফুল ইসলাম জানান আদর্শ গ্রামে প্রায় তিন হাজার বা তারও অধিক গাছ আছে। এখানে গাছী, গাছের মালিক ও সরবরাহকারীর মধ্যে ভিন্নতা আছে। রস সরবরাহকারীদের কেউ কেউ গাছের মালিক। আবার অনেকে গাছ মালিকের কাছ থেকে এক মৌসুমের জন্য গাছ বর্গা নিয়ে রস সংগ্রহ ও বেচা বিক্রি করে থাকেন। এক মৌসুমের জন্য গাছ প্রতি ৫-৬’শ টাকা মূল্য পরিশোধ করতে হয়। আবার গাছ পরিচর্যা ও গাছ নিংড়ে কলস বাঁধা, রস সংগ্রহ করার কাজে নিয়োজিত গাছিদের সংখ্যা ১৭-২০ জন। এদের দৈনিক মজুরি ৫-৭’শ টাকা। একজন গাছি দৈনিক ৮০-১০০’শ গাছ পরিচর্যা করতে পারে। প্রতি রাতের শেষ প্রহর বিশেষ করে ভোরের আলো ফোটার আগে রস সংগ্রহ সম্পন্ন করতে হয়। আদর্শ গ্রাম থেকে সংগৃহীত রস সোনাগাজী বাজার হয়ে সাইফুলের মত দশ বারোজন গাছ মালিক ও সরবরাহকারী সিএনজি যোগে নিয়ে আসেন ফেনী শহরে। সকাল সাতটা থেকে আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত সময়ে ফেনী শহরের বড় মসজিদের সামনে থেকে আগতরা রস কিনতে পারেন। এছাড়া মিজান রোড, কুমিল্লা বাস স্ট্যান্ড, মহিপাল, সদর হাসপাতাল মোড় এলাকায় উক্ত সময়ে চাহিদানুযায়ী রস সরবরাহ করেন তারা। রসের মূল্য কেজি প্রতি ৭০-৮০ টাকা। আবার অনেকে এদের কাছ থেকে রস নিয়ে অনলাইনে অর্ডার সংগ্রহ করে ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি করে থাকে।

রসের মিষ্টতার ভিন্নতা সম্পর্কে গাছ মালিক দুলাল মিয়া জানান গাছের রস আল্লাহর নেয়ামত, গাছ বেদে রসের স্বাদের ভিন্নতা হয়ে থাকে। আবার গণ কুয়াশা বা অতি মাত্রায় ঠান্ডা আবহাওয়া হলে রসের মিষ্টতা কমতে পারে। রস টক হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে দুলাল মিয়া এবং সাইফুল বলেন সূর্য উঠার পর বেশি সময় কাঁচা রস ধরে রাখলে রস টক হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই কাঁচা রস যত দ্রুত সম্ভব আগুনে নূন্যতম একঝাল নিংড়ে নিতে হবে।

খেজুর রস প্রচলিত খাদ্য হিসেবে বেশ সস্তা, পুষ্টিকর ও জনপ্রিয়। এতে আয়রন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাসের মতো খনিজ উপাদানের পাশাপাশি প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, গ্লুকোজসহ প্রচুর ভিটামিনের পুষ্টিগুণ রয়েছে। যা অনেকটা প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিংকের মতো কাজ করে। তাই কাজকর্মের দুর্বলভাব কাটাতে খেজুরের রসের জুড়ি নেই।
শীতকালের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডার মধ্যে কাঁচা খেজুরের রস খেতে পছন্দ করেন অনেকে। কেউ আবার এ রসকে প্রক্রিয়াজাত করে পিঠা-পুলি, পায়েস, গুড় তৈরি করে খেয়ে থাকেন। সারা বছর খেজুরের রস সংগ্রহ করা যায়। তবে শীতকালের খেজুরের রসই বেশি সুস্বাদু। শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে রসের পরিমাণ ও গুণগতমান কমতে থাকে। কাঁচা রস অনেকের প্রিয় হলেও এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে। তাই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ কাঁচা রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে নির্দেশনা দিয়ে আসছেন।

খেজুর রস এর স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক। এই রস থেকে তৈরি গুড় অনিদ্রা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেজুরের গুড়ে আয়রন বা লৌহ বেশি থাকে এবং হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে কর্মস্পৃহা ফিরিয়ে আনতে খেজুরের রস দারুণ উপকারী। খেজুরের গুড় আখের গুড় থেকে বেশি মিষ্টি, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। ঘ্রাণ ও স্বাদের জন্য এ গুড়ের রয়েছে বিশেষ চাহিদা। খেজুরের গুড়ে আখের গুড়ের চেয়ে বেশি প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেল রয়েছে। মৌসূমী রসের রাজা খেজুর রসের উৎপাদন ধরে রাখতে খেজুর গাছের চারা উৎপাদন ও এর চাষাবাদ বাড়াতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা যেমন জরুরি তেমনি সর্বসাধারণের এগিয়ে আসা উচিত। সাদা চিনি মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই চিনির বিকল্প হিসেবে খেজুর গুড়ের ব্যবহার বাড়ানো উচিত।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!