দৈনিক ফেনীর সময়

স্বাস্থ্যসেবা ও কম খরচে জনপ্রিয় মালয়েশিয়ার মেডিকেল ট্যুরিজম হাসপাতাল

স্বাস্থ্যসেবা ও কম খরচে জনপ্রিয় মালয়েশিয়ার মেডিকেল ট্যুরিজম হাসপাতাল

মো: এমদাদ উল্যাহ, চৌদ্দগ্রাম :

সঠিক স্বাস্থ্যসেবা ও কম খরচের কারণে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মালয়েশিয়া’র মেডিকেল ট্যুরিজম হাসপাতাল। প্রতিদিনই বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা ভ্রমণকালে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে থাকে। বিশেষ করে কর্মীদের সুন্দর আচরণে মুগ্ধ স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা ভ্রমণ-পিপাসু নারী-পুরুষ।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্যসেবা নিতে ভ্রমণকারীদের জন্য মালয়েশিয়া একটি জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক সফল গন্তব্য। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে অনেকবার যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা ভ্রমণ কর্তৃপক্ষ, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল ট্রাভেল জার্নাল (আইএমটিজে) পরিচালিত ‘ডেস্টিনেশন অব দ্যা ইয়ার’ শিরোনামের পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার জিতেছে মালয়েশিয়া। ভ্রমণ এবং স্বাস্থ্য্যসেবার জন্য একটি গন্তব্য হিসেবে ১.০৬ মিলিয়ন ইউরোপীয় পর্যটককে আকৃষ্ট করে দেশের দৃঢ় সুনাম অর্জন করেছে। ২০২২ সালে রেকর্ড করা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে ১.৩ বিলিয়ন রিঙ্গিত হেলথকেয়ার ট্রাভেলার (ইএইচটি) রাজস্ব আয় করে। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে মালয়েশিয়া বিশ্বব্যাপী শীর্ষ আন্তর্জাতিক চিকিৎসা পর্যটন গন্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। মূলত দেশটিতে ক্যানসার, মেরুদÐ, মস্তিষ্কসহ জটিল রোগ, পিঠব্যথা ও মেরুদÐের সমস্যার চিকিৎসা স্বল্পমূল্যে করা যায়।

জানা গেছে, পর্যটকদের গুণগত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিলের (এমএইচটিসি) নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার শীর্ষস্থানীয় হাসপাতালগুলোকে তাদের রোগীদের কাছে ব্যতিক্রমী সেরা স্বাস্থ্যেেসবাগুলো প্রদানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের মান বৃদ্ধিতে প্রতিশ্রæতি এবং প্রচেষ্টাকে বাড়িয়েছে। এর লক্ষ্য হলো মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য্যসেবার অবস্থানকে আরো শক্তিশালী, স্বাস্থ্য পরিষেবাকে নিরাপদ ও শীর্ষস্থানীয় গন্তব্যে পরিণত করা। এছাড়াও চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজগুলোকে শ্রেষ্ঠত্বে উন্নীত করা।

উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় রোগীর ফলাফল উন্নত করতে, খরচ কমাতে এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা প্রচার করতে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে। ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য রেকর্ড, টেলিমেডিসিন, পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য বিশ্লেষণ এবং ট্যুরিজম হাসপাতালগুলি একটি স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মূল উপাদান। ‘উন্নত দেশ গড়তে হলে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার বিকল্প নেই’ বিশেষজ্ঞদের এ অভিমতটিকে যথাযথ সম্মান করেই মালয়েশিয়ার মেডিকেল ট্যুরিজম হাসপাতাল এগিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে মালয়েশিয়ার চিকিৎসা পর্যটন শিল্প দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন প্রতি বছর বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য মালয়েশিয়া ভ্রমণ করে। এখানে রোগীরা সাশ্রয়ী মূল্যে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা গ্রহণ করে। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশটিতে নিবন্ধিত চিকিৎসক ছিল ৬৮ হাজার। অর্থ্যাৎ এশিয়ার প্রতি এক হাজার বাসিন্দার গড় চিকিৎসকের সংখ্যার মধ্যে এটি দশম স্থানে রয়েছে।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থ্য ডবিøউএইচও-এর মতে, স্বাস্থ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার এবং মানব উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। জাতিসংঘের ‘সার্বজনীন মানবাধিকার’ ঘোষণার ২৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাস্থ্যরক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য্যসেবা প্রাপ্তি জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার। পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে মালয়েশিয়ার সরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো অনেক উন্নত।

মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশী নাগরিক মেহেদী হাসান বলেন, মালয়েশিয়ায় চিকিৎসা সেবার খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। আপনার ফ্লাইট এবং বাসস্থানসহ চিকিৎসার মোট খরচ মার্কিন বা যুক্তরাজ্যের চিকিৎসার তুলনায় নগণ্য হবে। মালয়েশিয়ার সমস্ত চিকিৎসা কেন্দ্রে আধুনিক এবং উন্নত সুবিধা রয়েছে। এছাড়া তারা সর্বশেষ কৌশল এবং পদ্ধতিগুলি পরিচালনা করতে সক্ষম। সুবিধাগুলি আন্তর্জাতিক মানের সমান এবং কর্মীরা চিকিৎসা জগতের সর্বশেষ অগ্রগতির সাথে যোগাযোগ করে। জ্ঞানী এবং অনেক শীর্ষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে পরম যত্মে রোগীদের সেবা করেন। চিকিৎসা পর্যটকরা অবশ্যই সাশ্রয়ী মূল্যে সেরা ডাক্তারদের কাছ থেকে উচ্চমানের চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা সাবলীল ইংরেজিতে কথা বলেন, তাই চিকিৎসার সময় কোনো ভাষার বাধা থাকে না। প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল উচ্চতর সুবিধা দিয়ে সজ্জিত, যা রোগীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের সময় নষ্ট করা এড়াতে সহায়তা করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের হাসপাতালের তুলনায় এখানে পরীক্ষা এবং ফলো-আপ প্রক্রিয়া সহজে সম্পন্ন হয়। কর্মীরা চিকিৎসা ও পুনরুদ্ধারের প্রতিটি ধাপে আপনার এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের সাথে থাকে। আরামদায়ক থাকার জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হাসপাতালের কক্ষগুলি সু-সজ্জিত।

মালয়েশিয়ার নাগরিক হামিসা বিন্তে হারুন বলেন, ‘এখানে দুই শতাধিক আধুনিক হাসপাতাল রয়েছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় মালয়েশিয়ায় মেডিকেল ট্যুরিজমে খরচ অনেক কম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কর্মচারীদের সুন্দর আচরণের কারণে এ দেশের মেডিকেল ট্যুরিজম খাত উন্নত। এ জন্য সারা পৃথিবী থেকে প্রতিদিনই মানুষ নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভ্রমণ ও চিকিৎসার জন্য মালয়েশিয়ায় আসছে। ইতোমধ্যে সফল বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা ও ভ্রমণের গন্তব্য হিসেবে বিশেষজ্ঞদের ‘স্বাস্থ্যসেবা মার্ভেল’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ইউএসভিত্তিক আন্তর্জাতিক বসবাসের মাধ্যমে ২০১৫-২০১৮ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে ‘স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশ্বের সেরা দেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

গত আগস্ট মাসে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট ট্রাভেলস্ ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মালয়েশিয়ার মেডিকেল ট্যুরিজমসহ বিভিন্ন খাতের অগ্রগতি নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর মতে, একটি স্মার্ট দেশ তৈরিতে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো, শাসন এবং সামাজিক দিক সহ নানা বিষয় জড়িত। এরমধ্যে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো, শাসন, শিক্ষা এবং দক্ষতা, টেকসই চিকিৎসা, নাগরিক নিযুক্তি অন্যতম। এর সব কিছুই আছে মালয়েশিয়ায়।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যসেবা উন্নত দেশের একটি অপরিহার্য দিক। এখানে কিছু উপায় রয়েছে যার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে একটি উন্নত ও স্মার্ট দেশে একীভ‚ত করা যেতে পারে যেমন-ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড। একটি স্মার্ট হেলথ কেয়ার সিস্টেমের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ডের ব্যবহার। এই রেকর্ড রোগীর তথ্য সহজেই অ্যাক্সেসযোগ্য, নির্ভুল এবং আপ টু ডেট রাখতে সাহায্য করে। এটি রোগীর ফলাফল উন্নত করতে এবং চিকিৎসায় ত্রæটির সম্ভাবনা কমাতে পারে।

চার বছর আগে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেছেন বাংলাদেশের তরুণ কবি ও গবেষক ইমরান মাহফুজ। তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় মেডিকেল ট্যুরিজমসহ সব সেক্টরেই সুশৃঙ্খল পরিবেশ। এখানে কর্মীদের আচরণ সেবা প্রার্থীদের মুগ্ধ করে। এছাড়া স্বা¯’্যসেবার খরচও অন্যান্য দেশ থেকে তুলনামূলক কম। ফলে কম সময়ে মালয়েশিয়ার চিকিৎসা পর্যটন খাত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে’।

বিভিন্ন দেশে গবেষণার কাজে ভ্রমণ করেছেন অধ্যাপক কাজী শেখ ফরিদ। তিনি মেডিকেল ট্যুরিজম, পরিবেশ ও জনশক্তি সম্পর্কে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়া এমন একটি উন্নত দেশ, সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ নিজ দেশেই চিকিৎসা করিয়েছেন। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন নিজ দেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে, তখন সে দেশের অন্যান্য নাগরিক, কর্মস্থলে নিয়োজিত প্রবাসী ও ভ্রমণ পিপাসু ব্যক্তিরা অবশ্যই সেখানে চিকিৎসা করাবেন। বলা চলে-মেডিকেল ট্যুরিজমে মালয়েশিয়া বিশে^ নাম্বার ওয়ান হিসেবে বিবেচিত’।

চলতি বছরের মার্চ মাসে মালয়েশিয়ায় ফ্ল্যাগশিপ হাসপাতালের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেশটির হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ দাউদ মোঃ আরিফ বলেন, ‘মালয়েশিয়া সরকার দেশটির স্বাস্থ্য্যখাত উন্নয়নে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। আমরা স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত থেকে উন্নততর করার চেষ্টা করছি। আর উন্নতির পেছনে রয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে সেবা নিতে আসা ভ্রমণ-পিপাসু নারী-পুরুষ। এখানে চিকিৎসকদের আন্তরিকতার কারণে বেড়াতে এসে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নারী-পুরুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে’।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!